তিতের ছক চূড়ান্ত অনেক আগেই
সবার আগে রাশিয়ার টিকিট নিশ্চিত করে ফেলা ব্রাজিল দলের কোচ তিতে দল ঘোষণার জন্য ফিফা নির্ধারিত তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি। ফেব্রুয়ারি মাসেই তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বকাপে নিজের সেরা একাদশ। এমনকি বিশ্বকাপের দল ঘোষণার সময়ও শুরুতেই ২৩ জনের দল বলে দিয়েছেন তিতে। ফেব্রুয়ারিতে তিতের বলে দেওয়া শুরুর একাদশে বদল এসেছে একটিই। চোটের কারণে বিশ্বকাপেই খেলা হচ্ছে না দানি আলভেসের। এই রাইটব্যাকের জায়গায় দলে ঢুকেছেন ফাগনার।
১৭ জুন সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি দিয়ে শুরু হচ্ছে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ। এর আগে ২০১৪ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচটিই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সবশেষ ম্যাচ। যে ম্যাচটি ব্রাজিলভক্ত এমনকি ব্রাজিলের বাসিন্দাদের কাছে দুঃস্বপ্নের নামান্তর! এর আগে জার্মানির সঙ্গে সেমিফাইনালে ৭-১ গোলের হার। এই অন্ধকূপ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে অনেক সময়ই একটি প্রজন্ম লেগে যায়। ১৯৫০ সালের মারাকানাজোর দুঃখ ব্রাজিল ভুলেছিল ১৯৫৮ বিশ্বকাপে, পেলের পায়ের জাদুতে। ২০১৪-র মিনেইরাজোর দুঃখ ভুলতে এতটা সময় নিতে নারাজ সেলেসাওরা। প্রথমে রিও অলিম্পিকের সোনা, পরে লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে শীর্ষ দল হয়ে নেইমাররা জানান দিচ্ছেন, ওটা স্রেফ একটা দুর্ঘটনা।
মিনেইরাজোর পর ব্রাজিলের ফুটবলকর্তারা মনে করলেন, দলের রক্ষণটা জোরালো করা দরকার। আর যা-ই হোক, আরেকটি মিনেইরাজো হতে দেওয়া যাবে না। সেই সঙ্গে দলের শৃঙ্খলাটাও হতে হবে কড়া। তাই ২০১৪ বিশ্বকাপের ব্যর্থতার দায় নিয়ে লুই ফেলিপ্পে স্কলারি সরে দাঁড়ানোর পর কোচের পদে এনে বসানো হয় দুঙ্গাকে। ২০১০ বিশ্বকাপেও কোচ ছিলেন দুঙ্গা। কিন্তু দুঙ্গার ফুটবল দর্শন ছিল ব্রাজিলের ‘জোগো বোনিতো’র ঠিক বিপরীত। ছন্দময় ফুটবলের বদলে রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলেও দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালের বেশি দলকে নিয়ে যেতে পারেননি দুঙ্গা, তবু বিপর্যয়ের মুখে তাঁকেই দেওয়া হয় দায়িত্ব। কিন্তু এই মেয়াদেও ব্যর্থ হন দুঙ্গা, কোপা আমেরিকার পর পর দুই বছরে দুটি আসরে ব্যর্থতার ষোলোকলা পূর্ণ করে ব্রাজিল। নিয়মিত আসরে প্যারাগুয়ের কাছে টাইব্রেকারে হেরে ব্রাজিল বিদায় নেয় নকআউটের প্রথম রাউন্ডেই। শতবর্ষ উদ্যাপন আসরে তো গ্রুপ পর্ব থেকেই উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয় ব্রাজিল। বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের দুর্দশা। চিলির কাছে হার দিয়ে শুরু বাছাই পর্ব; আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ের সঙ্গে ড্র করার ফলে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ যাত্রাই অনিশ্চয়তায়। এরপর দুঙ্গাকে ছাঁটাই করল ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (সিবিএফ), পরদিন কোচ হিসেবে ঘোষণা করা হয় তিতের নাম।
ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে লিওনার্দো বাক্কি ওরফে তিতের জীবনটা থেমে যায় মাত্র ২৭ বছর বয়সেই। হাঁটুর চোটের কাছে হার মেনে। এরপর কোচিংকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া তিতে ইউরোপে কখনো কোচিং না করালেও নিজ জগতে উঁচুদরের একজন পেশাদার হিসেবেই পরিচিত। জাতীয় দলে যোগ দেওয়ার আগে কোরিন্থিয়ানসকে জিতিয়েছেন লিগ, কোপা লিবের্তাদোরেস, ক্লাব বিশ্বকাপসহ বেশ কিছু শিরোপা। তিতে দায়িত্ব নেওয়ার পরই বদলে গেল ব্রাজিল। বাছাই পর্বে কোণঠাসা অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শীর্ষ দল হিসেবেই এসেছে বিশ্বকাপে। প্রীতিম্যাচগুলোতেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে সেই চেনা ছন্দ।
তিতের পছন্দের ছক ৪-৩-৩। গোলবারে তিতে রেখেছেন অ্যালিসনকে। সিরি ‘এ’ দল এএস রোমার গোলরক্ষক অ্যালিসন দারুণ একটি মৌসুম কাটিয়েছেন। ক্লিনশিট রেখেছেন ১৭টি ম্যাচে। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে মৌসুমের সেরা ১৮ জন ফুটবলারকে নিয়ে যে দলটা বানানো হয়েছে, তাতে কেইলর নাভাসের সঙ্গে গোলরক্ষক হিসেবে আছেন অ্যালিসনও। ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার এই বলিষ্ঠ গোলরক্ষকই সামলাবেন ব্রাজিলের গোলবার।
দুই সেন্টারব্যাক প্যারিস সেন্ত জার্মেইর মারকুইনহোস ও ইন্টার মিলানে খেলা মিরান্দা। পিএসজি এবার ফরাসি লিগ, কাপ লিগ কাপ ও সুপার কাপসহ মোট চারটি শিরোপা জিতেছে। মারকুইনহোস গোটা মৌসুমে সব মিলিয়ে খেলেছেন ৩৫ ম্যাচ। লিগে মাত্র ২৯ গোল হজম করেছে পিএসজি, সব মিলিয়ে মৌসুমে ৪৮ গোল ঢুকেছে পিএসজির জালে। মারকুইনহোস এখন তাই চলে এসেছেন তিতের পছন্দের একাদশে। সঙ্গী মিরান্দা তাঁর সেরা সময়টা কাটিয়েছেন অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদে। ডিয়েগো সিমিওনের বজ আঁটুনির কৌশলে অভিজ্ঞ মিরান্দা গেল মৌসুমে খেলেছেন ইন্টার মিলানে। সিরি ‘এ’তে এবার চতুর্থ হয়ে ২০১১-১২ মৌসুমের পর ফের চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা পেয়েছে ইন্টার। লিগে ৩৮ ম্যাচের ৩১টিতেই খেলেছেন মিরান্দা, ইন্টার গোটা মৌসুমে হজম করেছে মাত্র ৩৬ গোল। এছাড়া সেন্ট্রাল ডিফেন্সে থিয়াগো সিলভা বিশ্বকাপ স্কোয়াডে থাকলেও নেই দাভিদ লুইজ।
লেফট ব্যাক হিসেবে মার্সেলো তাঁর জায়গায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের আত্মবিশ্বাস নিয়েই রাশিয়ায় পা রাখবেন মার্সেলো। নিলমার সান্তোস, রবার্তো কার্লোসদের সার্থক উত্তরসূরি মার্সেলোর নিজের দেশে গত বিশ্বকাপটা শুরু হয়েছিল দুঃস্বপ্নের মতো। উদ্বোধনী ম্যাচের ১১ মিনিটেই করে বসেছিলেন আত্মঘাতী গোল। এবার নিশ্চয়ই অমন কিছু চাইবেন না মার্সেলো। রক্ষণের সঙ্গে আক্রমণেও পটু মার্সেলো, ওভারল্যাপ করে উঠে বল জোগানের সঙ্গে গোলমুখী আচমকা শটেও বিভ্রান্ত করতে পারেন প্রতিপক্ষকে। রাইটব্যাক হিসেবে দানি আলভেসের চোটটা তিতের পরিকল্পনায় খানিকটা বাঁধ সেধেছে। তবে ম্যানচেস্টার সিটিতে খেলা দানিলো কোচের দুশ্চিন্তা অনেকাংশেই কমিয়ে দিয়েছেন। আলভেসের অভাবটা তিনি ভালোভাবেই পুষিয়ে দিতে সক্ষম।
ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের জায়গাটা অবধারিতভাবেই ক্যাসেমিরোর। রিয়াল মাদ্রিদের মাঝমাঠে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা ক্যাসেমিরোকে একই গুরুদায়িত্ব পালনে দেখা যাবে ব্রাজিল দলেও। সাও পাওলো থেকে রিয়ালের ‘বি’ দল হয়ে মূল দলে উত্থান, মাঝে এক মৌসুম ধারে পোর্তোয় খেললেও রিয়ালেই খেলেছেন বেশির ভাগ সময়। জুভেন্টাসকে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে হারাবার ম্যাচে তাঁর দূরপাল্লার শটের গোল এখনো চোখে ভাসে রিয়াল সমর্থকদের। প্রতিপক্ষের আক্রমণকে মাঝমাঠে থামিয়ে দিতে আর নিজ দলের আক্রমণের সূচনার গুরুদায়িত্ব নীরবে পালন করে যাচ্ছেন ক্যাসেমিরো। গতি নিয়ন্ত্রণ ও দিকনির্দেশনা—দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজই করতে হয় তাঁকে। সেটা পারেন বলেই পর পর দুই মৌসুম চ্যাম্পিয়নস লিগের সেরা দলে জায়গা করে নিয়েছেন এই ব্রাজিলিয়ান।
ক্যাসেমিরোর দুপাশে থাকবেন রেনাতো অগাস্তো আর পাউলিনিয়ো। কোরিন্থিয়ানসের সাবেক ফুটবলার রেনাতো অগাস্তো এখন খেলেন চীনা লিগের দল বেইজিং গুয়োয়ানে। ইউরোপে বেয়ার লেভারকুসেনেও খেলেছেন বছর চারেক। কোরিন্থিয়ানসে তিতে পেয়েছেন রেনাতোকে, তাইতো আস্থা রেখেছেন জাতীয় দলেও। পাউলিনিয়োর গল্পটা ঠিক উল্টো। টটেনহামে এসে মানিয়ে নিতে পারেননি, ক্লাবও তাঁকে খেলায়নি ঠিক জায়গাটায়। নিষ্প্রভ হয়ে চলে যাওয়া চীনে। সেখান থেকে বার্সেলোনায় ফিরে আসাটা রূপকথার মতোই!
আক্রমণভাগের ত্রিফলাটাই ব্রাজিলের চিরন্তন সৌন্দর্যের প্রতিনিধি। নেইমার, ফিলিপে কৌতিনিয়ো আর গ্যাব্রিয়েল জেসুস। নেইমারের চোট নিয়ে যে শঙ্কা ছিল, সব কেটে গেছে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচের গোলে। কৌতিনিয়োই তো হ্যাটট্রিক করে লেভান্তের বিপক্ষে মেসিবিহীন বার্সেলোনাকে প্রায় জিতিয়েই দিচ্ছিলেন! আর আছেন জেসুস। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে করেছেন ৭ গোল, ম্যানসিটিতে সবশেষ মৌসুমে লিগে ২৯ ম্যাচে ১৩ আর সব মিলিয়ে ৪২ ম্যাচে ১৭ গোল। সব মিলিয়ে স্বপ্নের একাদশ। তাঁদের পায়েই যে মিনেইরাজোর দুঃখ ভুলিয়ে হেক্সা জেতানোর চাবিকাঠি!