ক্লোসার রেকর্ডে চোখ ম্যুলারের
স্ট্রাইকারসুলভ কিছুই নেই। উচ্চতা ১.৮৬ মিটার। পা দুটি পেনসিলের মতো চিকন। ড্রিবলও করতে পারেন না খুব বেশি। এর পরও বিশ্বকাপে ১০ গোল টমাস ম্যুলারের! রহস্যটা কি? এর ব্যাখ্যায় একবার জার্মান সাবেক তারকা বাস্তিয়ান শোয়াইনস্টাইগার বলেছিলেন, ‘বায়ার্নের একাডেমিতে বেড়ে ওঠার সময় ভালো ডিফেন্ডার ছিল ম্যুলার। একজন ডিফেন্ডারই তো প্রতিপক্ষের ডিফেন্সের ছিদ্রটা চিনবে ভালো।’ জার্মান ঐতিহ্যবাহী দৈনিক ‘দ্য বিল্ড’ ম্যুলারকে নিয়ে লিখেছে, ‘বল ছাড়া বিশ্বের সেরা ফুটবলার’। তাই হয়তো। নইলে মিরোস্লাভ ক্লোসার বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ১৬ গোলের রেকর্ড ভাঙার স্বপ্ন দেখতেন কিভাবে? নির্দিষ্ট কোনো পজিশনও নেই তাঁর। দলের প্রয়োজনে খেলতে পারেন আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার, মূল স্ট্রাইকার, দ্বিতীয় স্ট্রাইকার কিংবা উইং—সবখানেই। এমন ‘অলরাউন্ডার’ ফুটবলেই বিরল।
ক্লোসার চেয়ে ম্যুলার এখনো বিশ্বকাপে পিছিয়ে ৬ গোলে। দূরত্বটা অনেক মনে হতে পারে। কিন্তু গ্রুপ পর্বে মেক্সিকো, সুইডেন বা দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে একটি হ্যাটট্রিক করে ফেললে? তখন কিন্তু ব্যবধান কমে দাঁড়াবে ৩-এ। বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক নতুন কিছু নয় ম্যুলারের জন্য। গত বিশ্বকাপের কথাই ধরুন। ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালের বিপক্ষে গ্রুপের প্রথম ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করেছিলেন জার্মান এই তারকা। তাঁর হ্যাটট্রিকে পর্তুগিজরা বিধ্বস্ত ৪-০ গোলে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে তাঁর একমাত্র গোলেই ম্যাচটি জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন জার্মানি।
ম্যুলার টুর্নামেন্টে নিজের পঞ্চম গোলটা করেছিলেন সেমিফাইনালে। মারাকানায় ব্রাজিলিয়ান ট্র্যাজেডি হয়ে থাকা ম্যাচে ১১ মিনিটে করেন গোল উৎসবের শুরুটা। শেষ পর্যন্ত ব্রাজিলকে দুমড়ে-মুচড়ে জার্মানি জেতে ৭-১ গোলে। নিজে গোল করার মতো সতীর্থদের দিয়ে করানোতেও জুড়ি নেই তাঁর। গত বিশ্বকাপেই অ্যাসিস্ট ৩টি। পাঁচ গোল আর তিন অ্যাসিস্টে সেবার জেতেন মর্যাদার দুটি শিরোপা। লিওনেল মেসির পেছনে থেকে সিলভার বল। আর হামেস রোদ্রিগেসের চেয়ে এক গোল কম করে পান সিলভার বুট।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০১০ বিশ্বকাপে আবির্ভাবেই অবশ্য নিজেকে চেনান ম্যুলার। গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪-০ গোলে জেতা প্রথম ম্যাচে এক গোল করে মান রাখেন কোচের আস্থার। শেষ ষোলোর ম্যাচে জার্মানির প্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ড। ওয়েইন রুনি, স্টিভেন জেরার্ড, ফ্রাংক ল্যাম্পার্ডদের নিয়ে ইংল্যান্ড এসেছিল অন্যতম ফেভারিট হয়ে। সেই ম্যাচে জোড়া গোলে রুনিদের বিদায় করে দেন ম্যুলার। ৩৭ মিনিট পর্যন্ত ১-২ গোলে পিছিয়ে থেকে ইংল্যান্ড ম্যাচে ছিল ভালোভাবে। কিন্তু ৬৭ থেকে ৭০—এই তিন মিনিটের ব্যবধানে দুই গোল করে জার্মানিকে কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট এনে দেন ম্যুলার।
লিওনেল মেসি, সের্হিয়ো আগুয়েরো, কার্লোস তেভেজদের নিয়ে আর্জেন্টিনা সেবার স্বপ্নের এক দল। ডিয়েগো ম্যারাডোনার হাত ধরে দাপটে পৌঁছেছিল কোয়ার্টারেও। কিন্তু ফেভারিট আর্জেন্টাইনদেন নিয়ে ছেলেখেলায় মাতে জার্মানি। মেসিরা ম্যাচটি হেরে বসেন ০-৪ গোলে! তিন মিনিটে প্রথম গোল করে জার্মানির হাতে ম্যাচের নাটাইটা এনে দিয়েছিলেন ম্যুলার। তাঁর দুর্ভাগ্য, সাসপেনশনের কারণে খেলতে পারেননি স্পেনের বিপক্ষে সেমিফাইনাল। ম্যাচটি ০-১ গোলে হেরে বিদায় নেয় জার্মানি। তবে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ফিরে আবারও গোল পান ম্যুলার। উরুগুয়েকে ৩-২ গোলে হারিয়ে সেবার তৃতীয় হওয়ার সান্ত্বনা জার্মানির। নিজের প্রথম বিশ্বকাপেই পাঁচ গোল আর তিনটি অ্যাসিস্টে জেতেন গোল্ডেন বুট। সেই সঙ্গে সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরস্কারটাও তাঁর।
আট বছর আগের সেই তরুণ আরো পরিণত হয়ে তৃতীয় বিশ্বকাপ খেলতে আসছেন রাশিয়ায়। এর আগে সফল আরো একটি ক্লাব মৌসুম কাটিয়েছেন বায়ার্ন মিউনিখে। জিতেছেন টানা ষষ্ঠ বুন্দেসলিগা। কাপ ফাইনালে পৌঁছেও অবশ্য হারতে হয়েছে ফ্রাংকফুর্টের কাছে। চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালে আরো একবার বুক ভেঙেছে রিয়াল মাদ্রিদ। মৌসুমজুড়ে ৪৫ ম্যাচে ১৫ গোল করা ম্যুলার ব্যর্থতাটা কাটাতে চান বিশ্বকাপে। জার্মানদের চাওয়ায় সেটা।