শেষ ৩০০ কিলোমিটার পথে সাবধানে বঙ্গবন্ধু-১
দেশের প্রথম নিজস্ব যোগাযোগ ও সম্প্রচার স্যাটেলাইট (কৃত্রিম উপগ্রহ) ‘বঙ্গবন্ধু-১’ উৎক্ষেপণের পর ৩৩ মিনিটেই পৌঁছে যায় মহাকাশের ৩৫ হাজার ৭০০ কিলেমিটার উচ্চতায়। বাকি ৩০০ কিলোমিটার পথ যাবে ধীরে ধীরে সতর্কতার সঙ্গে। এর জন্য কয়েক দিন লাগতে পারে। তবে উৎক্ষেপণের ৩৩ মিনিট পর থেকেই নিজের অবস্থান জানান দিতে শুরু করেছে বঙ্গবন্ধু-১। স্যাটেলাইটটি এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়ায় স্পেসএক্সের তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশনের নিয়ন্ত্রণে। এসব স্টেশনে বার্তা পৌঁছাচ্ছে বঙ্গবন্ধু-১ থেকে। তবে উৎক্ষেপণের এক ঘণ্টা ১০ মিনিট পর স্যাটেলাইটটি থেকে প্রাথমিক সংকেত পাওয়া শুরু করেছে গাজীপুর গ্রাউন্ড স্টেশনও। সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, পরিকল্পনা অনুসারে সব কিছুই ঠিকঠাক চলছে। স্যাটেলাইটটি এখন নিজ কক্ষপথে পৌঁছার উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। এয়ার ট্রাফিক এড়িয়ে কক্ষপথের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান নিতে এবং দেশের দুটি গ্রাউন্ড স্টেশনের নিয়ন্ত্রণে আসতে আট থেকে ১০ দিনের মতো লাগবে বলে আগেই জানিয়ে রেখেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এদিকে দেশের এই অর্জন উদ্যাপন উপলক্ষে রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে উৎসব আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। ঢাকায় মূল অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কম্পানি লিমিটেডের (বিসিএসসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম গতকাল শনিবার রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, রবিবার এই উদ্যাপনের তারিখটি নিশ্চিত করা হবে। রোজার আগে কয়েক দিনের মধ্যে এটি হতে পারে। এর আগে ৭ মে উৎক্ষেপণের তারিখ ধরে ৮ মে উদ্যাপন উৎসবের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু উৎক্ষেপণ পিছিয়ে যাওয়ায় আগের প্রস্তুতি স্থগিত করা হয়। স্যাটেলাইটটির বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, শেষ ৩০০ কিলোমিটার পথ ধীরগতিতে অতিক্রম করবে বঙ্গবন্ধু-১।
স্যাটেলাইট অধিকারী বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে গত শুক্রবার রাতেই আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সময় শুক্রবার বিকেল ৪টা ১৪ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৪ মিনিট) ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে স্যাটেলাইটটি সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়। যোগাযোগ ও সম্প্রচারের এই স্যাটেলাইট নিয়ে মহাকাশে রওনা হয় যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ অনুসন্ধান ও প্রযুক্তি কম্পানি স্পেসএক্সের ফ্যালকন-৯ ব্লক-৫ রকেট। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই রকেট বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের জন্যই প্রথম ব্যবহার করা হলো। বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণের মুহৃর্তটি বাংলাদেশের জন্যই শুধু নয়, মহাকাশ প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।
এই স্যাটেলাইটে ২৬ কেইউ-ব্যান্ড ও ১৪ সি-ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার রয়েছে, যা তৈরি করেছে ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস। এটি পরিচালনা করবে বিসিএসসিএল। বাংলাদেশ ও আশপাশের এলাকায় সেবা দিতে পারবে এ স্যাটেলাইট। এর কেইউ-ব্যান্ডের অধীনে থাকবে বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগরের জলসীমা। এর সঙ্গে ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ায় সেবা দিতে পারবে। এর মিশন অব্যাহত থাকবে কমপক্ষে ১৫ বছর।
স্যাটেলাইটটির উেপক্ষপণ দৃশ্য স্পেসএক্স সরাসরি তাদের ওয়েবসাইটে সম্প্রচার করে। রাত জেগে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর পাশাপাশি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত বড় পর্দার মাধ্যমে এই ঐতিহাসিক ক্ষণের সাক্ষী হয়েছে দেশের সর্বস্তরের মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ জেলা প্রশাসনগুলোর আয়োজনে এই উৎক্ষেপণ দৃশ্য দেখানো হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বহু বাংলাদেশিও এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সরাসরি সম্প্রচার প্রত্যক্ষ করে।
সংকেত পেয়েছে গাজীপুরের গ্রাউন্ড স্টেশন
গাজীপুর গ্রাউন্ড স্টেশনে স্যাটেলাইটটি থেকে সংকেত পাওয়ার কথা জানিয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, নিজ অরবিটাল স্লটে পৌঁছার উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাওয়ার এই সময়ে এটি গ্রাউন্ড স্টেশনগুলোতে সংকেত পাঠাচ্ছে। এভাবে এখন দিনে একাধিকবার সংকেত আসতে পারে। নিজ অরবিটাল স্লটে পৌঁছে গেলে তখন সার্বক্ষণিক যোগাযোগ হবে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরে প্রাথমিক এবং রাঙামাটির বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রে দ্বিতীয় গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব স্টেশনে ১৮ জন তরুণ প্রকৌশলী ফ্রান্সের প্রকৌশলীদের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন। এঁদের মধ্যে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির চারজন কাজ করছেন। এই চারজনের মধ্যে তিনজন ন্যানো স্যাটেলাইট ‘ব্র্যাক অন্বেষা’ প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন।
রকেটটি অন্তত ১০ বার ব্যবহার করা যাবে : ২০১৮ সালের ১১ মে শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের সময় বিকেল ৪টা ১৪ মিনিট কেবল বাংলাদেশের জন্যই নয়, মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর ক্ষেত্রে বা মহাকাশ প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও নতুন যুগের সূচনা করেছে। স্পেসএক্স যে রকেটের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিয়েছে সেই ফ্যালকন-৯ ব্লক ৫ অত্যাধুনিক প্রযুক্তির একটি রকেট। এটি সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের জন্যই ব্যবহার করা হলো। এর সফল ব্যবহারে স্পেসএক্সের কর্মকর্তারাও রোমাঞ্চিত।
স্পেসএক্সের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য প্রথমবারের মতো ফ্যালকন-৯ ব্লক ৫ রকেট ব্যবহার করা হয়েছে। এ মডেলের রকেটের চূড়ান্ত ও হালনাগাদ সংস্করণ এটি। এ রকেট এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে কম রক্ষণাবেক্ষণ করেই এটি অন্তত ১০ বার ব্যবহার করা যাবে।
স্পেসএক্স জানায়, ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করার ৩৩ মিনিট পর সেটি জিওস্টেশনারি ট্রান্সফার অরবিটে পৌঁছতে সক্ষম হয়।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও স্পেসএক্সের সাফল্যের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে বিবিসির প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘স্পেসএক্স ফাইল লেসন লার্নড রকেট’। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়, ২২৯ ফুট লম্বা ফ্যালকন-৯ ব্লক ৫ রকেট উৎক্ষেপণের স্টেজ ছিল দুটি। নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছে রকেটের স্টেজ-১ খুলে যায়, কাজ শুরু করে স্টেজ-২। এরপর সফলভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসে স্টেজ-১ এবং অবতরণ করে আটলান্টিকে ভাসমান ড্রোন শিপে। আর স্টেজ-২ পৌঁছে যায় জিওস্টেশনারি ট্রান্সফার অরবিটে।
পৃথিবীতে ফিরে আসা এই রকেটের স্টেজ-১ কোনো রকম মেরামত ছাড়াই ১০ বার ব্যবহার করা যাবে এবং স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ব্যয়ও এতে কমে আসবে।
স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণের আগেই স্পেসএক্সের প্রধান ইলন মাক্স গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ১০ বার ব্যবহারের পর রকেটটি কিছুটা মেরামত করে মোট ১০০ বার ব্যবহার করাও সম্ভব হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তাঁর তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল ফ্লোরিডায় এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রত্যক্ষ করে। ফ্লোরিডার স্বচ্ছ আকাশে প্রায় সাত মিনিট স্যাটেলাইটটি দেখা যায়।
শুভ উৎক্ষেপণ ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর : ‘বঙ্গবন্ধু-১’ স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এর শুভ উৎক্ষেপণ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নতুন এক যুগে প্রবেশ করল। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশও স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য হলো।
বিশেষজ্ঞের মূল্যায়ন : বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারি জ্যোতির্বিদ এফ আর সরকারের মূল্যায়নে এটি বাংলাদেশের জন্য বিশাল এক অর্জন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটির ওজন সব মিলিয়ে তিন হাজার ৭০০ কেজি। এর ৪০টি ট্রান্সপন্ডার রয়েছে। এতেই এর সক্ষমতা সম্পর্কে আমরা কিছুটা ধারণা পেতে পারি। এর অরবিটাল পজিশন হচ্ছে ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। এটা ভিয়েতনাম থেকে পূর্বে এবং ফিলিপাইনের পশ্চিমে। এই পজিশন ৮৮ বা ৯১ ডিগ্রি হলে আরো ভালো হতো। তবে যা পাওয়া গেছে তাতে টেলিকমিউনিকেশনসের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না।’
এফ আর সরকার আরো বলেন, ‘স্পেস টেকনোলজি হচ্ছে বর্তমানে সবচেয়ে সেরা প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি আরো উন্নত হবে। সে কারণে অন্যান্য বড় দেশের মতো আমাদেরও একটি স্পেস এজেন্সি করা দরকার। স্যাটেলাইটটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য, নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং আরো স্যাটেলাইট মাহকাশে পাঠানার জন্য পরনির্ভরতা কমাতে স্পেস এজেন্সি গঠন এখন সময়ের দাবি।’