জমি দখল চাঁদাবাজি সবই চলে মন্ত্রীর নামে
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। তিনি এখন মন্ত্রীর চেয়ারে নেই। আছেন এমপি। কিন্তু তার নামে ক্ষমতার অপব্যবহারও থেমে নেই। আপন ভাগ্নে সারোয়ার ও মজিবর যার অন্যতম উদাহরণ। রাজধানীর উত্তরা, মানিকদী, মাটিকাটা ও ভাষানটেক এলাকায় তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রভাবশালীরাও তটস্থ থাকেন। ব্যাপক চাঁদাবাজি ও দখলসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে এন্তার অভিযোগ। তবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাগ্নে হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আগ্রহ নেই অনেকের। এর ফলে ভুক্তভোগীরা হতাশ হয়ে একরকম হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এই যখন অবস্থা তখন আইনশৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ একটি বাহিনী বিষয়টিকে বিলম্বে হলেও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া সব অভিযোগ সমন্বয় করে প্রাথমিক অনুসন্ধানও শেষ হয়েছে।
সূত্র জানায়, সাধারণ মানুষ তো বটেই সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের সম্পত্তিও তাদের জবর-দখলের হাত থেকে রেহাই পায়নি। মাটিকাটা এলাকার বাসিন্দা কর্নেল ফতে কবীরের সম্পত্তি জবর-দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু কর্নেল ফতেহ কবীর নন, আরও বেশ ক’জন সামরিক কর্মকর্তার সম্পত্তিও জোরপূর্বক দখল করেছে সারোয়ার-মজিবর চক্র। কিন্তু পেশাগত সীমাবদ্ধতার কারণে এসব সামরিক কর্মকর্তা কোথাও অভিযোগ করতে পারছেন না। চাকরিজীবনের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে কেনা মূল্যবান ভূ-সম্পত্তি হারিয়ে ভুক্তভোগী এসব কর্মকর্তার অনেকেই এখন অসহায় হয়ে পড়েছেন।
অসহায় রমিজ উদ্দীন : সারোয়ার-মজিবরের জবর-দখলের শিকার এক ব্যক্তির নাম রমিজ উদ্দীন। জোয়ার সাহারা এলাকায় ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ পরিমাণ বহু মূল্যবান পৈতৃক জমি হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে। রমিজ উদ্দীন আইনশৃংখলা বাহিনীর একাধিক সংস্থার কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগও করেন।
এতে বলা হয়, পৈতৃক সূত্রে জোয়ার সাহারা মৌজার ৪৩২ নম্বর দাগের ১ দশমিক ৮৬ শতক জমির মালিক তিনি। নাবালক অবস্থায় তার বাবা মনির হোসেন মারা যান। এ সুযোগে একটি চক্র এ জমির এসএ রেকর্ড জালিয়াতি করে। সাবালক হওয়ার পর তিনি সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য আইনি লড়াই শুরু করেন। আদালতে এসএ রেকর্ড সংশোধনের জন্য মামলা করেন। একপর্যায়ে আইনি লড়াইয়ে তিনি জয়ী হন। এরপর নিয়মানুযায়ী এ জমির বিপরীতে যথারীতি তিনি খাজনা ও হোল্ডিং ট্যাক্সসহ যাবতীয় পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল পরিশোধ করে আসছিলেন। কিন্তু জমিতে নির্মাণকাজ শুরু করতে গেলে আবারও বিপত্তি বাধে।
রমিজ উদ্দীন তার অভিযোগে বলেন, গত ১৪ ডিসেম্বর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও বিক্রি করার এখতিয়ারসহ তিনি খান মো. আক্তারুজ্জামানকে আম-মোক্তার নিয়োগ করেন। আক্তারুজ্জামান ওই জমিতে উন্নয়নকাজ শুরু করা মাত্রই সেখানে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়। বলা হয়, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে সারোয়ার ও মজিবর ১৫-২০ জন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে উন্নয়ন কাজে বাধা দেয়। এ ঘটনা পুলিশকে জানানো হলে সারোয়ার-মজিবর পুলিশকে উদ্দেশ করে কটূক্তি করেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আইনশৃংখলা বিঘ্নিত হওয়ার আশংকা দেখা দেয়। পরে ক্যান্টনমেন্ট থানায় উভয় পক্ষকে জমির মালিকানাসংক্রান্ত কাগজপত্র উপস্থাপন করতে বলা হয়। রমিজ উদ্দীন তার মালিকানার সপক্ষে কাগজপত্র উপস্থাপন করলেও সারোয়ার ও মজিবর ভিন্ন পথ বেছে নেয়। তারা সংশ্লিষ্ট জমির ওপর কোনো প্রকার স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না মর্মে আদালতের নিষেধাজ্ঞাসংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে হাজির হয়। যাকে বলা হয়, স্থিতাবস্থা।
রমিজ উদ্দীন যুগান্তরকে বলেন, তার পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে বিভিন্নভাবে তাদেরকে হয়রানি করা হচ্ছে। এমনকি তার চাচাতো ভাই আইয়ুব আলীকে ডিবি পরিচয়ে অপহরণ করা হয়। মাটিকাটা এলাকার ইসিবি চত্বর থেকে আইয়ুব আলীকে তুলে নিয়ে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। একপর্যায়ে তার মৃত্যু হয়েছে ভেবে অপহরণকারীরা পূর্বাচল তিনশ’ ফুট প্রশস্ত রাস্তার পাশে তাকে ফেলে দিয়ে যায়। বর্তমানে তিনি পঙ্গু হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন।
আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে আসা এ সংক্রান্ত আরও অভিযোগ থেকে জানা যায়, সারোয়ার ও মজিবরের হাতে উত্তরা, মাটিকাটা, মানিকদী ও তুরাগ এলাকার বহু লোক তাদের সম্পত্তি হারিয়েছেন। এদের মধ্যে অন্যতম মানিকদী এলাকার বাসিন্দা হাজী আবদুস সালাম। জাল কাগজপত্র তৈরি করে তার পৈতৃক বসতভিটা দখল করা হয়েছে। বসতভিটা হারিয়ে সর্বস্বান্ত আবদুস সালাম এখন পথে পথে ঘুরছেন। এ ছাড়া মানিকদী এলাকার বাসিন্দা দীল গনি ও আবুল বাশারের পৈতৃক সম্পত্তি জবর-দখল করা হয়েছে। এ ছাড়া দিয়াবাড়ি এলাকার মৃত করম আলীর এতিম সন্তানদের প্রায় ৮ বিঘা সম্পত্তিও জবর-দখল করা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, এসব দখলবাজিতে সারোয়ার ও মজিবরকে সহায়তা করেন জনৈক পারভীন নামের এক নারী। পারভীন নিজেকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের বোন পরিচয় দিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের নানাভাবে চাপ দেন।
আইনশৃংখলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই তার ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে সারোয়ার ও মজিবর। দখল, চাঁদাবাজি ও পুলিশের বদলি-পদোন্নতির মাধ্যমে একেবারে নিঃস্ব অবস্থা থেকে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক বনে যায় তারা। রাতারাতি তাদের চেহারা পাল্টে যায়। ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকার বিভিন্ন আবাসন কোম্পানি তাদের চাঁদাবাজির কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে সাহারা খাতুন বাদ পড়লেও সারোয়ার ও মজিবরের ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ হয়নি। দখল ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ ছাড়াও রাজধানীর অভিজাত এলাকায় একাধিক বাড়ি ও দামি গাড়ির মালিক হয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও তারা বাড়ি কিনেছে বলে এলাকায় প্রচার আছে।
এদিকে এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের ব্যক্তিগত সহকারী মজিবর রহমান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, তাদের বিরুদ্ধে র্যাব-পুলিশের কাছে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের মিথ্যা অভিযোগ দেয়া হয়েছে। যার একটিরও প্রমাণ মেলেনি। রমিজ উদ্দীন নামের যে ব্যক্তির জমি জবর-দখলের অভিযোগ করা হচ্ছে তা মোটেও বস্তুনিষ্ঠ নয়। এ বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সারোয়ার বা আমি কোনো ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ড, সম্পত্তি দখল, চাঁদাবাজি বা বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িত নই। সম্পূর্ণ প্রতিহিংসাবশত আমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের মনগড়া অভিযোগ করা হয়ে থাকে। বাস্তবে এসব অভিযোগের কোনোটিই এখন পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি।