সন্ত্রাস দমন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান

সাম্প্রতিক সময়ে সন্ত্রাসী হামলায় দেশি-বিদেশি নাগরিকদের হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান হত্যার পর বাংলাদেশে নিজেদের কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত ওয়াশিংটন। এ পরিস্থিতিতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়টি বেশ জোর দিয়েই বলছে যুক্তরাষ্ট্র।

স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, নিশা দেশাই বিসওয়ালসহ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের তিনজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সফরের সময় ওয়াশিংটনের দেওয়া সহযোগিতা প্রস্তাবে বাংলাদেশ ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছে। ওই তিনজন কর্মকর্তার সফরের সময় নিরাপত্তা সহযোগিতার কোন কোন ক্ষেত্রে সহযোগিতা নেওয়া হবে ‘প্রয়োজনীয়তার মূল্যায়নের’ পর বাংলাদেশ তা সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছে। দুই দেশের নিরাপত্তা সম্পর্ক জোরদারে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতার কথা বারবার বললেও বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে এবারই প্রথম উল্লেখ করেছে কোন কোন ক্ষেত্রে সহায়তার প্রয়োজন। মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশ সাইবার (অন্তর্জাল) নিরাপত্তার অংশ হিসেবে প্রয়োজনীয় সফটওয়্যারের ব্যবহার, তথ্য আদান-প্রদান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সামর্থ্য বাড়াতে প্রশিক্ষণের কথা তুলেছে।

বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলাগুলোর পর যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনের ওপর জোর দিলেও এসব ঘটনার সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস ও আল-কায়েদার মতো জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততার কথা বারবার তুলেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সব সময় বলেছে, দেশীয় জঙ্গিরা এসব হামলার সঙ্গে জড়িত। এমন এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আইএস ও আল-কায়েদার বাংলাদেশে উপস্থিতির বিষয়টিতে আটকে না থেকে যুক্তরাষ্ট্র এ মুহূর্তে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশও এ প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, সামগ্রিক এ পরিস্থিতির কারণে আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় দুই দেশের অংশীদারত্ব সংলাপেও সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনের প্রসঙ্গটি বিশেষ গুরুত্ব পাবে। আগামী ২৪ ও ২৫ জুন ওয়াশিংটনে দুই দেশের পঞ্চম অংশীদারত্ব সংলাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মতো বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে আমাদের নিজেদের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন প্রয়োজন। এরপর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে সহযোগিতার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতাকে বিশেষভাবে বিবেচনায় নেওয়া যায়।’

* নিজেদের কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ওয়াশিংটন
* বাংলাদেশ তিনটি বিষয়ে সহযোগিতায় আগ্রহী
* জুনের অংশীদারত্ব সংলাপে গুরুত্ব পাবে নিরাপত্তার প্রশ্ন

গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (ইউএসআইডি) কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু মাহবুব তনয়ের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। ওই ফোনালাপের ধারাবাহিকতায় হত্যার তদন্তের সর্বশেষ অগ্রগতি ও নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে কথা বলতে ঢাকায় আসেন মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। তাঁর সফরের সময় আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তা বাস্তবায়নে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনার জন্য ঢাকা সফর করেন মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মুখ্য উপসহকারী মন্ত্রী উইলিয়াম টড। এমন এক পরিস্থিতিতে মার্কিন কূটনীতিকদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে গত মঙ্গলবার দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কূটনৈতিক নিরাপত্তাবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী গ্রেগরি স্টার। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের তিনজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিশা দেশাই, উইলিয়াম টড ও গ্রেগরি স্টার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের জন্য তাঁরা ধন্যবাদ জানান। তবে নিজেদের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করতে নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রস্তাব করার পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা দেওয়ার কথাও জানান মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা। গ্রেগরি স্টার বাংলাদেশে তাঁর মার্কিন সহকর্মীদের নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রস্তাব করেন বলে জানা গেছে।

ঢাকার কর্মকর্তারা মনে করছেন, সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা বললেও উগ্রপন্থীদের হামলা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে জুলহাজ মান্নানের মতো মার্কিন সরকারের একজন কর্মকর্তাকে বেশ কিছুদিন অনুসরণের পর যেভাবে হত্যা করা হলো, তাতে তাঁর অন্য সহকর্মীদের নিরাপত্তা নিয়েও বিচলিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ তৈরি হয়েছে। এভাবে এখানে যে কারও সন্ত্রাসীদের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া ৯/১১-পরবর্তী বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের বিস্তার, লিবিয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নির্মম হত্যার অভিজ্ঞতায় জুলহাজের মৃত্যু বাংলাদেশে মার্কিন কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিয়ে ওয়াশিংটনকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাই মার্কিন কূটনীতিকদের নিরাপত্তাকে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতির কারণে এখানে নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক এলাহী চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ও বিদেশি নাগরিকদের হতাহত করতে যেসব জঙ্গিবাদী হামলা ঘটছে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকবে। তাই এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে আমাদের সাবধান হতে হবে। বিভিন্ন দেশের সহযোগিতা নেওয়ার ব্যাপারে কোনোরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব রাখা ঠিক হবে না।’
তাঁর মতে, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে ভারত ও মিয়ানমারকে নিয়ে আঞ্চলিক এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা উচিত।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে সহযোগিতা ঘনিষ্ঠতর করার ব্যাপারে দুই দেশ সম্মত হলেও এখনই নতুন করে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। ২০১৩ সালের অক্টোবরে দুই দেশের মধ্যে সই হওয়া ‘বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ সহযোগিতা উদ্যোগ’ শীর্ষক সমঝোতা স্মারকের আওতায় দুই দেশ নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা আরও বাড়াবে।

ওই সমঝোতা স্মারকে সন্ত্রাসবাদ, আন্তসীমান্ত অপরাধ ও সন্ত্রাসী সংগঠনের বিস্তৃতি রোধ করতে দুই দেশ জোরালো অঙ্গীকার করেছে। এতে কার্যকরভাবে সন্ত্রাসবাদ দমনে আধুনিক কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে সামর্থ্য বাড়ানো, মুদ্রা পাচার ও সন্ত্রাসবাদের অর্থায়ন রোধ, দুই পক্ষের প্রয়োজন অনুযায়ী সমন্বিত সাইবার অপরাধ রোধে নিরাপত্তা এবং বন্দর ও সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত, নীতিমালা চূড়ান্ত করার সমীক্ষায় সহযোগিতার পাশাপাশি সন্ত্রাসী হামলা-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় অভিজ্ঞতা বিনিময়ের কথা বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি পারস্পরিক সম্মতিতে ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নিয়ে আলোচনার উল্লেখ আছে ওই সমঝোতা স্মারকে।