নিয়ন্ত্রণে সব সংস্থার যৌথ নজরদারির সিদ্ধান্ত
প্রতিবছরই রমজানের আগে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়া যেন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে মনে করে, বাজারে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর মনিটরিং না থাকায় এই অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। এবার বছর শেষে রয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ফলে নির্বাচনের আগে রমজানের বাজার নিয়ন্ত্রণ করলে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে ভোটের রাজনীতিতে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, রমজানের আগে কখনোই নিত্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিক থাকে না। চাঁদাবাজি, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, বাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পর্যাপ্ত মনিটরিং না থাকাসহ বেশ কিছু কারণে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়। এবার যেহেতু বছর শেষে নির্বাচন, সরকার চাইলে সমস্যাগুলোর সমাধানে হস্তক্ষেপ করতে পারে। এতে ভোক্তাসাধারণ যেমন বাড়তি খরচের হাত থেকে রক্ষা পায়, এর সুফলও যাবে সরকারের পকেটে। অবশ্য মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এমনিতেই বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারের দায়িত্ব।
ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই সময়টায় বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে না দেওয়াটা সরকারের কাজ; কিন্তু কখনোই সেটা করা হয় না। বছরের পর বছর এমনটি চলে আসছে। সামনেই ভোট। সরকার যদি এবার রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে তাহলে নির্বাচনে এর সুফল পাবে।’
রাজধানীর হাতিরপুল বাজারে গতকাল শনিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩৫-৫০ টাকা, প্রতি কেজি সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা, প্রতি কেজি খোলা ও প্যাকেটের চিনি ৬০ টাকা, ছোলা ৭০ থেকে ৯০ টাকা, মসুর ডাল ৭০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষা, যৌক্তিক দামে পণ্য বিক্রি, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট করতে না দেওয়া এবং ভেজাল পণ্যের বাজারজাত বন্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিং টিম, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ), বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই), জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, র্যাব-পুলিশের ভ্রাম্যমাণ আদালত সরাসরি কাজ করে থাকে। এর পাশাপাশি ট্যারিফ কমিশন পণ্যের দেশি-বিদেশি মূল্য এবং বাজার পরিস্থিতির তথ্য দিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করে। অবৈধভাবে কেউ পণ্যের মজুদ গড়লে সেই তথ্যও সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে।
এ বছর বাজার মনিটরিংয়ে এই সংস্থাগুলো অন্য বছরের চেয়ে বেশি কার্যকর থাকবে বলে জানা গেছে। রাখা হবে বাজারে বাড়তি নজর। এরই মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বাজার তদারকি শুরু করেছেন। কেউ মজুদ গড়ছে কি না, ভেজাল পণ্য তৈরি করছে কি না, ব্যবসায়ীরা বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে কি না—এসবের ওপর নজর রাখছেন তাঁরা। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও সরকারকে বাজার পরিস্থিতি বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবে বলে জানা গেছে।
পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-এইচআর অ্যান্ড মিডিয়া) আব্দুল আলীম মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুলিশ বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অসাধু কারবারিরা যাতে ভেজাল পণ্য বাজারজাত করতে না পারে সে জন্য পুলিশ ও র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত সার্বক্ষণিক বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধেও পুলিশ জিরো টলারেন্স নীতিতে অভিযান পরিচালনা করবে।’
পুলিশের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাইকমান্ড থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যেকোনো মূল্যে মজুদদারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। সিআইডি গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কাজ শুরু করেছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা যাতে বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।’
পুলিশের এ কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বেশ আগেভাগেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বাজার পরিস্থিতি মনিটরিং করতে।’ নির্বাচনের বছর বলে বাজার মনিটরিংয়ে বাড়তি চাপ রয়েছে বলেও জানান তিনি।
আগের বছরগুলোতে বাজার মনিটরিংয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঢিলেঢালা ভাব থাকলেও এবার গুরুত্বসহকারে নেওয়া হয়েছে। বাজার অস্থির করা সিন্ডিকেটের জন্য এটি একটি সতর্কতা সংকেত। কেউ বাজারে কোনো ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর জন্য রমজানের পুরো মাস বিভিন্ন সংস্থার বাজার মনিটরিং, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা থাকবে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএফএসএ) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রমজানে অনেকে ভেজাল পণ্যের পসরা নিয়ে বসে। ভেজাল পণ্যের সরবরাহ বন্ধ করতে এবার আমরা নিয়মিত মাঠে থাকব। মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি ভেজাল কারবারিদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। এর জন্য নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।’
বাজার নিয়ন্ত্রণে বছরজুড়ে দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা দেখা না গেলেও প্রতিবছর রমজান মাসে সজাগ হয় টিসিবি। এবারও রোজা শুরুর ১১ দিন আগে থেকে সংস্থাটি ট্রাকে করে দেশজুড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পাঁচটি পণ্য ন্যায্য মূল্যে বিক্রি শুরু করেছে। পণ্যগুলো হলো সয়াবিন তেল, চিনি, মসুর ডাল, ছোলা ও খেজুর। সব মিলিয়ে খোলা বাজারে সাত হাজার ১০০ টন পণ্য বিক্রি করবে টিসিবি।
এর পাশাপাশি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বিএসটিআই, র্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেকে নিয়মিত দেশজুড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। যারা বেশি দামে পণ্য বিক্রি, পণ্যের অবৈধ মজুদ, ভেজাল পণ্য বিক্রির চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শফিকুল ইসলাম লস্কর বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই বাজারে অভিযান পরিচালনা করছি। দেশজুড়ে অনেক টিম কাজ করছে। এবার রমজানে এই অভিযানের সংখ্যা আরো বাড়ানো হবে। শুক্র ও শনিবারও অভিযান চলমান থাকবে।’
সম্প্রতি সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর অভিযোগে ঢাকার শ্যামবাজারের পাইকারি বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পেঁয়াজের বস্তায় পরিমাণ ও দাম স্পষ্ট করে লেখার জন্য। নির্দেশ না মানলে কঠিন ব্যবস্থা নেবেন অভিযান পরিচালনাকারীরা।
মোড়কজাত পণ্যের মান ও দাম নিয়েও মাঠে নামবে বিএসটিআই। বিএসটিআই এরই মধ্যে বাজার থেকে অনেক পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে।
রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে। সেসব বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, বাজারে পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে সব পণ্যের। সুতরাং দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। আজ রবিবার আবারও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, রমজানে প্রয়োজনীয় সব পণ্যেরই পর্যাপ্ত মজুদ আছে। এ পরিস্থিতিতে কোনো অসাধু ব্যবসায়ী দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয় গঠিত মনিটরিং টিম, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা মাঠে থাকবে। জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসকদের দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে মনিটরিং জোরদার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।