বিশৃঙ্খল গণপরিবহন, রক্তাক্ত রাজপথ, দায় দায়িত্বশীলদের

transport-5ad8abb9dbdb9

কারণ একটাই, দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতা। গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা এবং সড়ক দুর্ঘটনার কথা বলছি। দেশের সবচেয়ে বেশি জনসম্পৃক্ত একটি খাতকে সুশৃঙ্খল করার জন্য সরকারের নীতি নির্ধারক থেকে শুরু করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং পরিবহন সংগঠন— কেউই দায়িত্ব নেয়নি, নিচ্ছে না। বরং গত কয়েক বছরে গণপরিবহন খাতে অরাজকতা আরও বেড়েছে। খোদ রাজধানীতে উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সাধারণ মানুষকে বেশি ভাড়ায় নিম্নমানের বাস সার্ভিসে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে বাধ্য করা হয়েছে। ফলে সার্বিক বিশৃঙ্খলা ও সীমাহীন অনিয়মের যোগফল হচ্ছে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু অথবা পঙ্গুত্ববরণ। সড়কে এসব মৃত্যু, পঙ্গুত্বের জন্য প্রথম ও প্রধান দায় অবশ্যই সরকারের দায়িত্বশীলদের।

দায়িত্বহীনতার কথা থেকেই শুরু করি। এক্ষেত্রে ক’দিন আগে রাজধানীতে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে রাজীব হোসেনের মৃত্যুর কথাই সবার আগে চলে আসে। দুই বাসের পাল্লায় প্রথমে হাত ও পরে প্রাণ হারান সরকারি তিতুমীর কলেজের এই শিক্ষার্থী। কিন্তু সড়কে বাস চালকদের এই অরাজকতা কেন?

এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, বিআরটিসির ড্রাইভিং স্কুল ছাড়া চালকদের প্রশিক্ষণে আর কোনো ড্রাইভিং স্কুল গড়ে ওঠেনি। জেলায় জেলায় ড্রাইভিং স্কুল স্থাপনের বিষয়টিও কার্যত আলাপ-আলোচনার মধ্যেই রয়ে গেছে। ফলে ‘হেলপার থেকে চালক’ হওয়ার সনাতনী রীতিই রয়ে গেছে গণপরিবহনে। আর তাদের ওপরই নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এই চালকেরা যেমন প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ পায় না, তেমনি তারা যখন পেশায় স্থায়ী হয় তখনও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভেতরে থাকে না। এখনও রাজধানীতে গাড়ি চলে মালিকের সঙ্গে চুক্তিতে। দিনে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা জমার চুক্তিতে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামার পর চালকের মাথায় শুধু সবার আগে যাওয়ার এবং বেশি যাত্রী তোলার চিন্তাই কাজ করে। যে আগে পৌঁছবে সে আগে ট্রিপ পাবে। ফলে আগে যাওয়ার ‘মরণ দৌড়’ অনিবার্য হয়ে পড়ে তাদের জন্য। যাত্রী কেন, নিজের বাসটির প্রতিও তার কোনো মায়া থাকে না। পাল্লা দিতে গিয়ে যাত্রীর নিরাপত্তা দূরে থাক, নিজের নিরাপত্তার কথাও ভুলে যান চালকরা। লুকিং গ্লাস ভাঙছে, ধাক্কা লেগে বাস ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে— এসবের কিছুই দেখার সময় নেই তাদের।

ঢাকায় দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ নিম্নমানের মিনিবাস। এক সময় রাজধানীতে নিরাপদ সার্ভিস, রোড স্টার, বিআটিসির দ্বিতল ভলভো বাস সার্ভিস চালু হয়েছিল। কিন্তু মিনিবাস মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে এসব সার্ভিস টিকতে পারেনি। ফলে রাজধানীবাসী জিম্মি হয়ে পড়ে ঝুঁকিপূর্ণ এসব মিনিবাসের কাছে। শুধু বেসরকারি বাস আমদানিই নয়, সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিসিও বার বার নিম্নমানের বাস আমদানি করছে; যেগুলো ছয় মাসের বেশি রাস্তায় টিকতে পারে না। ওই যে একবার দ্বিতল ভলভো বাস আনা হয়েছিল, সেটাই বিআরটিসির ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো বাস আমদানি। কিন্তু জনপ্রিয় সেই বাস সার্ভিস বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ নিজেরাই ছলে বলে কৌশলে বন্ধ করে দেয়! এখন আবার বিআরটিসির অধিকাংশ বাস চলে লিজে। বিআরটিসির চালক-হেলপাররাই লিজের বাস চালাচ্ছেন। দুর্ঘটনা হলে দায়ও বিআরটিসি নিতে চায় না। বাস সার্ভিস পরিচালনার সক্ষমতা যদি বিআরটিসির না থাকে, তাহলে সরকারের এই প্রতিষ্ঠান রাখা কেন? দেশের মানুষ নিশ্চয়ই ‘মহাজন’ বিআরটিসি চায় না, চায় সেবাদাতা বিআরটিসি।

মেট্রো আরটিসি নামেও একটি কর্তৃপক্ষ রয়েছে। গত কয়েক বছরে তারা ঢাকায় প্রায় দুই শ’ রুটে বাস চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। মিরপুর থেকে কালসী, ফ্লাইওভার হয়ে এয়ারপোর্ট সড়কে রুট সৃষ্টি করে বাস চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এয়ারপোর্ট সড়কে মিরপুরের গাড়ির চাপে অন্য কোনো রুটের বাসে চড়াই দায়। রাজধানীতে সত্যিকার অর্থে কতটি রুট প্রয়োজন, প্রতি রুটে কত বাস দরকার— তার কোনো পরিকল্পনাই মেট্রো আরটিসি করে না। ফলে রাজধানীতে রুট নিয়ে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা স্পষ্ট। এই বিশৃঙ্খলা সড়ক দুর্ঘটনা এবং যানজটেরও অন্যতম কারণ।

আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও বড় দুর্বলতা রয়েছে। সড়কে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে পুরনো আইন বদলে নতুন আইন প্রণয়নে  সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় ব্যর্থ হয়েছে বলা চলে। আইন করার সময় এর বিধি-বিধান নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে সুযোগ সন্ধানী পরিবহন শ্রমিক নেতারা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চালকের মৃত্যুদণ্ডের বিধানের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হবে উচ্চহারে জরিমানা আরোপ। বেপরোয়া গাড়ি চালানো, রাস্তার মাঝখানে যাত্রী নামানোর জন্য অন্তত পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা হওয়া উচিৎ। আর জরিমানা পরিশোধে ব্যর্থ হলে চালকের কারাদণ্ডের বিধান থাকা দরকার। চালক দুর্ঘটনা ঘটাবে আর মালিককে দায় নিতে হবে— এ ব্যবস্থা বন্ধ না হলে রাস্তায় চালকের বেপরোয়া আচরণ বন্ধ সম্ভব নয়। তাই চালকের জরিমানা ও তাৎক্ষণিক শাস্তির বিধান নিশ্চিত হওয়া জরুরি। নীতি নির্ধারকরা কত দেশ ভ্রমণ করেন, অথচ তারা দেখেন না অন্য দেশে ট্রাফিক আইন অমান্যের জন্য কী হারে জরিমানা নির্ধারণ রয়েছে! উচ্চহারে জরিমানা আরোপে কিসের ভয় তাদের?

পরিবহন শ্রমিক সংগঠন নামধারী কিছু মোড়লের গোষ্ঠীস্বার্থের আধিপত্যও সড়কে অরাজকতার জন্য অনেকাংশে দায়ী। সংগঠনের কাজ যেন গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও চালকদের সুরক্ষা দেওয়া। এদের কারণে মালিকরা নিজেদের পছন্দমত চালকও গাড়িতে রাখতে পারেন না অনেক সময়। এছাড়া যখনই নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে চালকদের ইউনিফর্ম দেওয়া, পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে রাখা এবং আইন অমান্যের ক্ষেত্রে মোটা অংকের জরিমানার প্রস্তাব আসে তখনই তার বিরোধিতা করে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পরিবহন শ্রমিক সংগঠন নামধারী এসব মোড়ল। এসব সংগঠনের কাছে প্রশাসন যতদিন নতজানু থাকবে ততদিন রাস্তায় বিশৃঙ্খলা বন্ধ হবে না, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

সবশেষে বলতে হয়, রাজপথে প্রতিদিন যে অসংখ্য মৃত্যু, গুরুতর আহতদের আহাজারি, সুস্থ মানুষের একের পর এক পঙ্গু হয়ে যাওয়ার যে বেদনা, তার দায় অবশ্যই সরকারের। এই দায় থেকে মুক্তি পেতে হলে সরকারকে অবশ্যই গণপরিবহন খাতকে সুশৃঙ্খল করার উদ্যোগ নিতে হবে। আর তা হতে হবে এখনই। গণপরিবহনকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা কঠিন কিছু নয়, দরকার শুধু সদিচ্ছার।