একটি দেশের অভ্যন্তরীন নীতি নির্ধারণ করে সে দেশের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে। মূলত অভ্যন্তরীন নীতির উপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্র অন্য একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে তার বাণিজ্যিক, সামরিক, সাংস্কৃতিকসহ অন্যান্য সম্পর্কের রূপটি নির্ধারণ করে। অভ্যন্তরীন নীতিতে যখন পরিবর্তন দেখা যায়, তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই পররাষ্ট্রনীতিতে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাশিয়ার সঙ্গে সৌদি আরবের কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি। ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এ দুটি দেশের (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ১৯৯০ পরবর্তী রাশিয়ার অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে যে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নামে পরিচিত ব্যবস্থাটির পতনের ফলে, তা দুদেশের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ‘মহাজোট’ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। দেশের রাজনীতিতে ১৯৭৫পরবর্তী সময় থেকে ভিন্নধারা সূচিত হয়েছিল, অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম যে ভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা, সেখান থেকে সরে এসে রাষ্ট্রীয় এবং জাতীয় পরিচিতিতে পাকিস্তান আমলের মতো ধর্মের পরিচয় ফিরিয়ে আনা হয়।
এরই সূত্র ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৭১এর যুদ্ধাপরাধীরা পুনর্বাসিত হয় এবং ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীতাকারী দল এবং ব্যক্তিরা রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনবার প্রচেষ্টা নেয়। যার প্রেক্ষিতে জাতি, জাতীয়তা এবং রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে আবার অসাম্প্রদায়িকতার ধারা ফিরিয়ে আনবার প্রয়াস নেওয়া হয়, যদিও দলের অভ্যন্তরীন এবং বহিস্থ নানাবিধ চাপের ফলে রাষ্ট্রধর্ম-সংক্রান্ত ধারাটি সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া দলটির পক্ষে সম্ভব হয়নি।
অবশ্য একটা বিতর্ক থেকেই যায়; সেটা হল, ১৯৭৫পরবর্তী দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে পুনরুথান এবং বিকাশ ঘটেছিল এর প্রভাবে নিজস্ব দলীয় রাজনীতিকে অগ্রসর করবার জন্য দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নিজেরও কিছু মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে কি না, যার ফলশ্রুতি হল সাম্প্রদায়িক চেতনার সঙ্গে দলের আসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সংযোজনের চেষ্টা।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক ধারায় রাষ্ট্রকে নিয়ে যেতে না পারলেও, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে ইতিহাসের দায় শোধের যে উদ্যোগ আওয়ামী লীগ নেয় সেটা মুক্তিযুদ্ধের মূল স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের যে বিপুল জনগোষ্ঠী দেশকে এগিয়ে নিতে চায়, তাদের কাছে ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকারি এবং বেসরকারি দুভাবেই ইতিহাসের এ দায় শোধের উদ্যোগের বিরোধিতা করে আসছে। পাকিস্তানের এ ক্রমাগত বিরোধিতা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্কের ভিত্তি কী হওয়া উচিৎ এ প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে।
উল্লেখযোগ্য যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের ধারায় বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবার প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন নীতিতে যে পরিবর্তন এসেছে, তার প্রতিফলন পররাষ্ট্রনীতিতে বিশেষত পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত প্রতিফলিত হয়নি।
পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আজকে তিনটি ভিত্তির উপরে নির্ধারিত হওয়া উচিৎ বলে অনেকে মনে করেন। প্রথমত, ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে বাংলাদেশের কাছে সরকারিভাবে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা। দ্বিতীয়ত, ১৯৫ জন অভিযুক্ত পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে তাদের কৃতকর্মের বিচারের জন্য বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর। তৃতীয়ত, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান যে ধংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তার জন্য এবং এর পাশাপাশি বাংলাদেশকে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীন উপিনিবেশে’ পরিণত করে অর্থনৈতিক সম্পদের যে লুণ্ঠন করেছিল, তার ক্ষতিপূরণ প্রদান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানি এবং জাপান গণহত্যায় তাদের সংশ্লিষ্টতার জন্য অনেকবার সরকারিভাবে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। বিশেষত জাপানকে আমরা অনেক বার গণচীন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে দেখেছি। তাহলে পাকিস্তান কেন ক্ষমা প্রার্থনা করল না?
এখানে যে প্রশ্ন দাঁড়ায় তা হল, কখন যুদ্ধে পরাজিত একটি রাষ্ট্র নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে। পরাজিত রাষ্ট্র মূলত দুটি কারণে ক্ষমা প্রার্থনা করে। প্রথমত, তার উপরে যদি বিজয়ী রাষ্ট্রের এবং এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রচণ্ড চাপ থাকে যেটি তার পক্ষে অগ্রাহ্য করা সম্ভব না হয়। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধপরবর্তী সরকারে যারা ক্ষমতাসীন হন তারা যদি নৈতিকতার জায়গা থেকে গণহত্যার বিষয়টি সমর্থন না করেন বা ভয়াবহ অপরাধ বলে মনে করেন।
শুধু আন্তর্জাতিক চাপের কারণেই নয়, বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানি এবং জাপানে অধিষ্ঠিত প্রত্যেকটি সরকারই গণহত্যাকে ঘৃণ্য অপরাধ বলে মনে করবার কারণেই বারবার ক্ষমা চাইতে কুণ্ঠা বোধ করেনি। কিন্তু ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে অবস্থাটি ছিল ভিন্ন। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে তখন পাকিস্তানের উপর কার্যকর চাপ তৈরি করা সম্ভব ছিল না। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পুনর্গঠন ছিল তখন সদ্যস্বাধীন দেশে আসীন সরকারের অগ্রাধিকার।
পাশাপাশি, শীতল যুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির মেরুকরণের ফলে ১৯৭১ সালে সংগঠিত গণহত্যার ব্যাপারে বিশ্বশক্তি ঐক্যবব্ধভাবে পাকিস্তানের ব্যাপারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। এছাড়া যুদ্ধোত্তর পাকিস্তানে বর্তমান সরকারসহ সামরিক এবং বেসামরিক যতগুলি সরকারই ক্ষমতাসীন হয়েছে, তারা সবাই ১৯৭১ সালে সংগঠিত গণহত্যার প্রতি এক ধরনের প্রছন্ন নৈতিক সমর্থন পোষণ করে এসেছে। ফলে তারা কোনোভাবেই গণহত্যার ব্যাপারে ক্ষমা চাওয়ার নৈতিক দায় অনুভব করেনি।
সুতরাং পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করবে এ ধরনের চিন্তা বাতুলতা মাত্র। তাহলে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের করণীয় কী? বাংলাদেশের সিভিল সমাজ-বা কী করতে পারে এ বিষয়ে?
বাংলাদেশ সরকারের এ মুহূর্তে যেটা করা উচিৎ তা হল, সার্কসহ বিভিন্ন ফোরামে গণহত্যার বিষয়টি তুলে ধরে এ সমস্ত ফোরামের মাধ্যমে পাকিস্তানের উপর ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করা। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককেও বাংলাদেশ ক্ষমা চাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। বাংলাদেশ নানাভাবে পাকিস্তানের কাছে এ বার্তা পৌঁছাতে পারে, পাকিস্তান যদি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা না চায় সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে পক্ষে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা কঠিন হবে।
আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ বিস্তারে ভূমিকার কারণে পাকিস্তান এমনিতেই নানামুখী চাপের মাঝে রয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সঙ্গে গণহত্যাজনিত কারণে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি রাষ্ট্রটির অবস্থান আরও কোনঠাসা করে ফেলবে। সুতরাং বাংলাদেশ সরকারের উচিত পাকিস্তান ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত সে দেশের সরকারের ওপর আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানামুখী চাপ অব্যাহত রাখা।
পাশাপাশি, বাংলাদেশের সিভিল সমাজের যে অংশটি মুক্তিযুদ্ধের ধারায় বাংলাদেশ গড়তে চান তাদের উচিত– আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাস্ত্রের ভাষায় যাকে ‘ট্রাক ২ কূটনীতি’ বলে– সে ধরনের কূটনীতিক যোগাযোগ পাকিস্তানি সিভিল সমাজের সঙ্গে বৃদ্ধি করা।
আজকের পাকিস্তানি তরুণ সমাজের একটি উল্লখযোগ্য অংশ (যদিও এরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়), তাদের পূর্বসূরীদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত। এরা তাদের সেই অসমসাহসী সত্যিকারের মানবিক পূর্বসূরীদের সেই ক্ষুদ্র অংশটির প্রতিনিধিত্ব করে, যারা সেই সময়ে পাকিস্তানে বসেই ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তার গণহত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন। তাদের কেউ কেউ আরও সাহসিকতার সঙ্গে গণহত্যার প্রতিবাদ করেই ক্ষান্ত হননি বরং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনের সংগ্রাম যে ন্যায্য– এ বক্তব্য দিয়ে বাংলার জনগণের মুক্তির আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থন দিয়েছিলেন।
এদের উত্তরসূরী এ তরুণ প্রজন্ম মনে করে, এখন পাকিস্তান সরকারের উচিত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এটি সহজেই অনুমেয় যে, পাকিস্তানি জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই ১৯৭১ সালের গণহত্যা সম্পর্কে অজ্ঞ। ১৯৭১ সাল থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন দলমত নির্বিশেষে সকল সামরিক ও বেসামরিক সরকার সচেষ্ট থেকেছে পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীকে তাদের সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যার বিষয়ে অজ্ঞ রাখতে।
বাংলাদেশের সিভিল সমাজের উচিত প্রাথমিকভাবে এ উত্তর প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে পাকিস্তানের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সামনে ১৯৭১ সালের তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের কৃতকর্ম তুলে ধরা। এতে যেটা হবে সেটা হল, বিবেকবোধসম্পন্ন পাকিস্তানি সিভিল সমাজের অংশটি জনগণের একটি অংশকে সঙ্গে নিয়ে সরকারের উপর ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করবে।
এই সিভিল সমাজের কাছে বাংলাদেশের সিভিল সমাজের ১৯৫ জন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীর বিষয়টি তুলে ধরা দরকার। একজন অপরাধী, অপরাধীই। জাতীয়তা ও ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের পরিচয় নির্বিশেষে অপরাধীর বড় পরিচয় হল সে একজন অপরাধী। পাকিস্তানি জনগোষ্ঠীর বড় অংশটি এ অপরাধীদের বিষয়ে পুরোপুরি অজ্ঞ।
১৯৫ জন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীর প্রতীকী বিচারের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এর পাশাপাশি প্রসিকিউসন টিমের উচিত এ ১৯৫ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা। এতে ট্রাইব্যুনাল এদের বিরুদ্ধে সমন জারি করতে পারবে। সমন জারি করার পরও যদি তারা উপস্থিত না হন, তাহলে তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার করা যাবে, যেমন কিছু যুদ্ধাপরাধীর বিচার তাদের অনুপস্থিতিতে করা হয়েছিল।
আর এ বিচারে যদি তাদের দোষ প্রমাণিত হয় এবং শাস্তির রায় হয়, তাহলে ইতিহাসের দায় কিছুটা হলেও শোধ করা যাবে। পাশাপাশি, যুদ্ধাপরাধীদের হস্তান্তরের ব্যাপারে পাকিস্তানের উপর একটা বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে।
১৯৫ জন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের উচিত পাকিস্তানের সরকারের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত ধবংসযজ্ঞের ক্ষতিপূরণ চাওয়া। বাংলাদেশে অর্থনীতি এবং নীতিনির্ধারক যেসব চিন্তক গোষ্ঠী রয়েছেন তাঁরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক কী পরিমাণ সম্পদের ক্ষতি হয়েছে অর্থমূল্যে তার পরিমাপ করে দেখতে পারেন। শুধু সম্পদের কথা বলছি এ কারণে, যে হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণ সংগঠিত হয়েছে অর্থাৎ মানবিক ক্ষতি হয়েছে, তার মূল্য অর্থমূল্যে নির্ধারণ সম্ভব নয়।
পাশাপাশি, চব্বিশ বছর– পাবলো গঞ্জালেজ কাসানোভা যেটাকে বলেছেন ‘অভ্যন্তরীন উপনিবেশ’– পূর্ব পাকিস্তানকে সেই অভ্যন্তরীন উপনিবেশে পরিণত করে যে পরিমাণ অর্থনৈতিক শোষণ করা হয়েছে, তার পরিমাণ নির্ধারণ করা দরকার। দ্বিজাতি-তত্ত্বের উপর গড়ে ওঠা পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্রচ্ছন্নভাবে দ্বিজাতি-তত্ত্বকে অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে বিনির্মিত করে দুই অর্থনীতির তত্ত্ব গড়ে তোলা হয়।
এ বিনির্মিত দ্বিজাতি-তত্ত্বে, পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে তাদের মাঝে নানা দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও এক জাতিসত্তা হিসেবে কল্পনা করা হত। বেনেডিক্ট এন্ডেরসন যাকে জাতিগঠনের মূল ভিত্তি হিসেবে Imagined Community বা কল্পিত গোষ্ঠী বলেছেন– পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর কাছে সে কল্পিত গোষ্ঠী ছিল শুধু পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী।
অপরদিকে, পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী তাদের চোখে ছিল– জার্মান দার্শনিক হেগেলের ‘অপর’ ধারাণাটি নিয়ে পরবর্তীতে উত্তর-উপনিবেশিক অধ্যয়নের পণ্ডিতরা যে অর্থে ‘অপর’ বলেছেন– সে অর্থে ‘অপর’। এ ‘অপর’ হল উপনিবেশিক শোষণের ক্ষেত্র। অর্থনীতি এবং নীতিনির্ধারক চিন্তক গোষ্ঠীগুলির তৎকালীন এবং বর্তমান বাজার মূল্যে নির্ধারণ করা উচিত চব্বিশ বছরের উপনিবেশিক শোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধেকালীন ধ্বংসযজ্ঞ করে পাকিস্তানি শাসকরা কী পরিমাণ ক্ষতি করেছে।
সরকারের পাশাপাশি দেশের সিভিল সমাজের উচিত পাকিস্তানি সরকার এবং জনগণের কাছে এ ক্ষতির পরিমাণ জানিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষতিপূরণ চাওয়া। এছাড়া এ বার্তাও দেওয়া উচিত যে, বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণ পাকিস্তানের বর্তমান নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে অবহিত এবং পাকিস্তানের পক্ষে যে অর্থমূল্যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব নয় সে সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল।
শশি থারুর অক্সফোর্ড ইউনিয়ন বিতর্কে বলেছেন, ব্রিটেনের উচিত উপনিবেশ স্থাপনের জন্য ভারতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে আগামী দুশ বছর প্রতীকীভাবে প্রতি বছর এক পাউন্ড করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া। তেমনিভাবে বাংলাদেশ সরকার এবং সিভিল সমাজের উচিত উপনিবেশ স্থাপন এবং যুদ্ধাপরাধজনিত কারণে ব্রিটেন, জার্মানি এবং ইতালি কর্তৃক ক্ষতিপূরণের বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরে, পাকিস্তানের দুর্বল অর্থনীতির কারণে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে বর্তমান বাজার মূল্যে প্রকৃত ক্ষতিপূরণ দাবি না করে, ক্ষমা চাওয়া-পূর্বক আগামী পঁচিশ বছর যাবত প্রতীকী অর্থে প্রতি বছর এক রুপি করে বাংলাদেশকে ক্ষতিপূরণ দিবে—- এ বার্তা পাকিস্তান সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
আজকের প্রজন্মের পাকিস্তানি জনগণ বা তাদের পূর্বসূরীদের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণের কোনো বিরোধ বা সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যাটি হচ্ছে পাকিস্তান নামক ধারণাটি (the idea of Pakistan) নিয়ে এবং তাকে প্রতিনিধিত্বকারী প্রতীক অর্থাৎ তার নিশানটি নিয়ে। এ ধারণা এবং প্রতীকটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ত্রিশ লক্ষ মানুষকে খুন এবং চার লক্ষ নারী মুক্তিযোদ্ধার সম্ভ্রমহানির বিষয়টি।
এ প্রতীক এবং ধারণা যতদিন পৃথিবীতে টিকে থাকবে, এ দুটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হওয়া গণহত্যা এবং সম্ভ্রম হারানোর মতো ঘটনা বিযুক্ত করা সম্ভব হবে না। আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া, প্রতীকী ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী সৈনিকের বিচারে সহযোগিতার মাধ্যমে পাকিস্তান কিছুটা হলেও অতীত পিছনে ফেলে এ দুটি দেশের ভবিষৎ সহযোগিতা এবং সম্পর্কের নতুন দিগন্তের উন্মোচন করতে পারে।