মৌলবাদী জঙ্গিদের হুমকির মুখে বাকস্বাধীনতা

একের পর এক ব্লগার হত্যার ঘটনা এখন সারা বিশ্বেই আলোচিত এবং সমালোচিত৷ বাংলাদেশে ব্লগারদের জীবন আজ হুমকির মুখে৷ জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো যেন তাঁদের জীবন নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। একের পর এক ব্লগার খুন হচ্ছেন তাদের নাস্তিক্যবাদী লেখালেখির কারনে। ইসলামী উগ্রবাদীদের হাতে একের পর ব্লগার, লেখক, অনলাইন এক্টিভিস্ট ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের মৃত্যুর ঘটনা এবং রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্লগাররা।

মুক্তমনা লেখকদের অনেকেই খুন হয়েছেন গত প্রায় বছরখানিক ধরে। আরও অনেকেই আজ হুমকির মুখে। অনেকেই দেশ ছেড়েছেন এবং ছাড়ছেন হুমকির মুখে। বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসন ও তাদের নিরাপত্তা দিতে আজ অপারগ। বরং তারা ব্লগারদের উপদেশ দিচ্ছেন দেশান্তর করার জন্য।

সম্প্রতি ব্লগার হত্যার পেছনে বাংলাদেশের পুরনো মৌলবাদী সংগঠন জেএমবি, হিজবুত তাহিরীর সহ আনসারবাংলা টিম-এর জড়িত থাকার অনেক আলামত পাওয়া গেছে। তাছাড়া আনসার বাংলা টিম বিভিন্ন সময় তাদের টার্গেট এর লিস্ট প্রকাশ করেছে বিভিন্ন মাধ্যমে। তাদের প্রকাশিত টার্গেট এর তালিকার মধ্যে আসিফ মহিউদ্দিন, অনন্য আজাদ, তসলিমা নাসরিন, মারুফ রসূল, নাস্তিকের ধর্মকথা, ইমরান এইচ সরকার, আবু সায়েম কনক ওরফে কামিকাজি, আরিফ জেবতিক দাঁড়িপাল্লা ধমাধম, সাঈদুর রহমান, আরিফুর রহমান, সৌরভ সরকার অন্যতম। এদের মধ্যে বেশিরভাগই দেশের বাইরে কিংবা যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

আনসার বাংলার হুমকির বিষয়ে অনন্য আজাদের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন “মুক্তমনা ব্লগাররা বাংলাদেশে আর নিরাপদ নেই। স্বাভাবিক থাকাটা আমার জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। আমি মৌলবাদের বিরুদ্ধে লেখি। যুদ্ধাপরাধী আর ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে লেখি। আমি তাদের বিরুদ্ধে লেখি যারা সমাজকে ভুল পথে চালিত করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে। ফলে, মানুষ মনে করে আমার লেখা তাদের জন্য ক্ষতিকর। এ কারণে তারা আমাকে হত্যা করতে চায়। কয়েক মাস ধরে আমি বলতে গেলে প্রায় লুকিয়ে বাস করছি; আমার চাকরি ছেড়েছি, লেখালেখি কমিয়ে এনেছি, আমার ওয়েবসাইট বন্ধ রেখেছি। আমার জন্য জীবনের স্বাভাবিকতা হারিয়ে গেছে।”

গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন “একের পর এক লেখক ও ব্লগার হত্যার ঘটনায় মনে হচ্ছে, বিভিন্ন দিক থেকে আমাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিচ্ছে। এসব মৃত্যু আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিস্তব্ধ করে দিচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে একটি মানবিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের সূচনা হয়। সে সময় থেকে ঘাতকরা মুক্তচিন্তা ও মুক্তমনাদের তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর আমাদের আর্তনাদ এবং এর প্রতিবাদে রাস্তায় নামলে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ঘাতকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোন ব্যবস্থা তো নিচ্ছেই না, উল্টো তথ্য ও যোগাযোগ আইনে ব্লগারদের গ্রেফতার করে কারাগারে পুরছে।”

মুক্তমনা ব্লগের প্রদায়ক ও লেখক মারুফ রসূল বলেন, “জর্জ হ্যারিসন বেঁচে থাকলে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এ গাওয়া তার গানের প্রথম লাইনটি সম্ভবত পরিবর্তন করতেন। এখন কি গচ্ছে। আমার প্রিয় বাংলাদেশে নিরন্তর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের দ্বারা আমার এই মাতৃভূমি আজ বিদীর্ণ। একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগকে আমরা স্বাগত জানিয়েছিলাম। আশ্চর্যজনকভাবে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো মুক্তমনা, লেখক, ব্লগার ও প্রকাশকদের দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। খুনিরা একই কায়দায় একের পর এক হত্যা করে গেলে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতগুলো আরও মর্মান্তিক। এ অবস্থায় যে কোন নাগরিকের জন্য বাংলাদেশ একটি বিপদজনক রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে।”

আবু সায়েম কনক ওরফে কামিকাজি বলেন, “বাংলাদেশ বর্তমানে ব্লগারদের জন্য বসবাসের জন্য সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আমাদের পরিচিত অনেক ব্লগাররা প্রতিটি মুহূর্ত জীবনাশঙ্কায় কাটাচ্ছে। রাষ্ট্রও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। আমরা হয়তো দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গেছি কিন্তু যারা দেশে আছেন এবং এখনও লেখালেখির সাথে জড়িত আছেন, তাদের জন্য সত্যি খুব কষ্ট হয়। ”

আরেক অনলাইন এক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক বলেন, “আমার হৃদয় ভেঙ্গে গেছে। মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম, আমাদের আরও বন্ধুকে হয়ত হারাতে হবে। মাঝে মাঝে খবরগুলো আমাকে প্রশান্তি দেয় যে, এবারের শিকার তো আমি নই। একজন মানুষের জন্য এটা সবচেয়ে ভীতিকর বিষয় যে, রাষ্ট্রের প্রতি যখন আস্থা থাকে না, তখন তার সব আশা-ভরসা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়।”

আতঙ্কিত ব্লগার, প্রথাবিরোধী, বিজ্ঞানমনষ্ক, মুক্তমনা লেখক ও তাদের উদ্বিগ্ন পরিবারের স্বজনদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে-এর পরের টার্গেট কে?

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, মূলত অভিজিৎ রায়ের হত্যার পর শুরু হয় ব্লগারদের দেশছাড়ার প্রক্রিয়া। এ পর্যন্ত ৩০ জনের বেশি ব্লগার দেশ ছেড়েছেন। তাদের মধ্যে ২০ জন যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইডেনসহ ইউরোপের দেশগুলোয় রয়েছেন। বাকিরা পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়।

এদিকে, এমন অব্যাহত হুমকির মুখে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণ যারা দেশ ছাড়তে পরেননি তারা ঘরে স্বেচ্ছাবন্দি বেছে নিচ্ছেন। নিরাপত্তার জন্য পুলিশের কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে তাদের।

এব্যাপারে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, হুমকির মুখে ব্লগাররা থানায় জিডি করলেও থানা পুলিশের কিছুই করার থাকে না। তার মতে, এ ধরনের জিডির তদন্ত করা কঠিন। কারণ মোবাইলের কল লিস্ট বা ফেসবুক ধরে তদন্তের প্রযুক্তি থানায় নেই। ডিবির আছে। তবে এ ধরনের জিডির তদন্ত করতে হলে আদালতের অনুমতি নিতে হয়। এই হলো আইনি বেড়াজাল। যার কারণে নিরাপত্তাহীনতায় দেশের ব্লগাররা। খুন হচ্ছে একের পর এক।

এদিকে, প্রতিটি খুনের পরই প্রশ্ন উঠছে_’হু ইজ নেক্সট?’ দেশে একের পর এক নৃশংসভাবে ব্লগার হত্যাকান্ডে ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টদের মনে এখন একটাই প্রশ্ন। শুধু প্রশ্নই নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি ধিক্কার ও ঘৃণাসহ তাদের মধ্যে বিরাজ করছে মহা আতঙ্ক। এ আতঙ্ক শুধু ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বস্তরের মুক্তমনা প্রগতিশীলদের মাঝেও। গত দুই দিনে প্রায় সকল ব্লগ ও ফেসবুকে মুক্তমনা লেখকদের পোস্টগুলোতে চোখ রাখলেই বোঝা যায় যেন এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে তাদের মাঝে। দুর্বৃত্তদের হাতে অকালে প্রাণ দিচ্ছেন মুক্তচিন্তার এসব মানুষগুলো। ঘটনার পর পরই মামলা হচ্ছে। আটকও হচ্ছেন দু-চার জন সন্দেহভাজন।

কিন্তু বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ব্লগার বা মুক্তমনের লেখক হত্যার বিচারের এ দশা পরিবার ও স্বজনদের মাঝে হতাশাই ছড়াচ্ছে। যে কারণে প্রকাশক দীপন হত্যার পর তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছিলেন, আমি কোনো বিচার চাই না। এ একই কথা বলেছেন নিহত ব্লগার অভিজিতের স্ত্রীও। তিনি ব্লগে লিখেছেন, দীপনের বাবার মতো আমিও বিচার চাই না।

যদিও ব্লগারদের উপর হামলা শুরু হয় ২০১৩ সালে তবে এর আগে ২০০৪ সাল থেকে প্রথাবিরোধী মুক্তমনা লেখকদের ওপর একই কায়দায় হামলা চালানো হয়। ওই বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে বাংলা একাডেমির সামনে দুর্বৃত্তরা অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং তাকে হত্যার চেষ্টা করে। বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হলেও ঐ বছরের ১১ আগস্ট জার্মানিতে মারা যান এই লেখক।

এসব ব্লগার বা মুক্তমনা লেখকদের হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোই পুলিশের সন্দেহের তালিকায়। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বার বার ‘তদন্ত চলছে, আসামি ধরা পড়বে, বিচার হবে’। কিন্তু বাস্তবে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা আর নতুন খুনের ঘটনা একটি আরেকটিকে চাপা দিচ্ছে।

গত বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় বিজ্ঞানমনষ্ক লেখক অভিজিৎ রায়কে, মারাত্মক আহত হন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা হলে তদন্তে নেই অগ্রগতি নেই বললেই চলে। পুলিশ জানিয়েছে, অভিজিৎ হত্যাকান্ডের পর ঘটনাস্থল থেকে ১১টি আলামত এফবিআই নিয়ে যায় পরীক্ষার জন্য। তাদের ফরেনসিক পরীক্ষার রিপোর্ট এখনো হাতে না পাওয়ায় অভিজিৎ হত্যার তদন্ত ধীরগতিতে চলছে।

গত বছর ১২ মে সকালে সিলেটে খুন হন ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। তার মামলার এখনো শুনানিই শুরু হয়নি। গত বছরের ৭ আগস্ট রাজধানীর খিলগাঁওয়ে খুন হন ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীল। এই হত্যা মামলাটিরও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান।

যদিও ব্লগার হত্যাকান্ড গুলোর মধ্যে শুধুমাত্র আহমেদ রাজীব হায়দারের মামলার রায় হয়েছে গত বছর ৩১ ডিসেম্বর। নিহত রাজীবকে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করার কথা স্বীকার করে আসামিরা আদালতে জবানবন্দি দিলেও সব আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়নি। যার কারণে এই রায় প্রত্যাখ্যান করেছে রাজীবের পরিবার ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। নিহত রাজীবের বাবা বলেছেন, এ রায় প্রভাবিত। তিনি বলেন, সব আসামি মিলে পরিকল্পনা করে হত্যা করেছে আমার ছেলেকে। প্রত্যেকের কেন ফাঁসি হবে না? মামলায় আট আসামির মধ্যে দু’জনকে ফাঁসির দন্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এক আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয় আদালত।