বিচারকদের অসম্মানজনক বিদায় বন্ধ হবে: আইনমন্ত্রী

সোমবার মন্ত্রিসভা আইনটির খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেওয়ার পর নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ অভিমত প্রকাশ করেন তিনি। ওই খসড়া তৈরির পর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার কাছে সে বিষয়ে মতামত চেয়ে না পাওয়ার কথাও এসময় সাংবাদিকদের জানান আনিসুল হক।আইনমন্ত্রী বলেন, “অপসারণের প্রক্রিয়া আইন দ্বারা নির্ধারণ করা হবে- এটা ১৯৭২ সালের সংবিধানে লেখা ছিল। ২০১৩ সালের সেম্টেম্বর মাসে এই জিনিসটা আবারও উল্লেখ করেছি।“১৯৭২ থেকে শুরু করে ১৯৭৭ পর্যন্ত এই ব্যাপারে কোনো আইন হয় নাই। তারপর এটাকে বিলুপ্ত করা হয়। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করা হয়। সেখানেও কিন্তু কোনো প্রক্রিয়া লেডাউন করা হয় নাই। একদম পরিষ্কার, এটাতো একজনকে অপসারণ করা হচ্ছে। তার অধিকার, যারা অপসারণ করবেন, তাদের এখতিয়ার- এসব কিছুই আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিৎ।”বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিতে ২০১৪ সালের ১৮ অগাস্ট সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবে সায় দেয় মন্ত্রিসভা। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বিল সংসদে পাস হয়।এর ফলে ‘অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের’ অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিচারকের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে যায়, যে ক্ষমতা স্বাধীনতার পর চার বছর পর্যন্ত আইন প্রণেতাদের হাতে ছিল।

আইনমন্ত্রী বলেন, সংবিধান সংশোধনীর পর এ আইনের কাজ শুরু হলে খসড়া অনুলিপিতে আইন কমিশনের পাশাপাশি প্রধান বিচারপতির মতামত চাওয়া হয়।“জবাবে উনারা বলেছেন, হাই কোর্টে এই বিষয়ে একটি মামলা রয়েছে। তাই এই আইনে আমরা কোনো অভিমত দিতে পারব না।“মন্ত্রিসভা থেকে আজ অনুমোদিত হয়েছে। তার মানে মন্ত্রিসভার কাজটা হলো, কিন্তু মতামত নেওয়ার সুযোগটা কিন্তু রয়ে গেছে।”আনিসুল হক বলেন, “উনারাই যেহেতু একমাত্র স্টেক হোল্ডার। উনাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করবো। উনারা যে পরামর্শ দেন, সেটা আইন করার সময় অবশ্যই আমরা বিবেচনা করব। এটা (আইন তৈরির কাজটা) অনেক দিন আগে করা উচিত ছিল।” “আমাদের ৭২’র সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদ ছিল। কিন্তু ১৯৭৬ সালের পর থেকে অন্ততপক্ষে ৮-৯ জনকে সরানো হয়েছে। তাদের মধ্যে বিচারপতি কেএম সোবহান, বিচারপতি আব্দুর রহমান চৌধুরী, বিচারপতি এসএম হোসেন- এই তিনজনকে বলা হলো, আপনারা আজ থেকে আর জজ না। হয় পদত্যাগ করেন, নয় চাকুরি খাব। এই হুমকি তাদের দেওয়া হয়েছে।”বিচারপতিতের ‘অসম্মানজনক বিদায়ের’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেনের ঘটনাও তুলে ধরেন আইনমন্ত্রী।“বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন, তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। রেজিস্ট্রারকে কোথা থেকে একটি ফোন করা হলো। প্রধান বিচারপতিকে জিজ্ঞাসা করেন, উনি সকালে পত্রিকাটা কি পড়েছেন? যদি পড়ে থাকেন, তাহলে উনি কি আছেন? তখন তিনি গিয়ে আইনজীবীরা যেখানে দাঁড়ায়, সেখানে দাঁড়িয়ে বলেন, আপনি আজকে একটু আদালত মুলতবি করেন। “উনিতো বুঝে নিয়েছেন। তারপর যখন উনি উঠে গেলেন, তখন খাস কামরায় গিয়ে পত্রিকাটা দেওয়া হলো। তখন দেখা গেল উনি নাই।” আনিসুল হক বলেন, তার বাবা তখন সুপ্রিম কোর্টআইনজীবী সমিতির সভাপতি। তখন খবর দেওয়া হলো, দ্রুত একটা ব্যবস্থা করে তাকে বিদায় সংবর্ধনাদেওয়া হলো।“এই সবতো একটা অসম্মান করে বিদায় করা। এখানে আত্মপক্ষ সমর্থন তো দূরে থাক, কোনো পক্ষ সমর্থনের সুযোগ নাই। সেই ক্ষেত্রে আমরা মনেকরলাম, বিচারপতিদের এই রকম অসম্মান করতে আর দেওয়া যেতে পারে না। তাদের অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের। সেই সুরক্ষা দিতে এখানে আইন করা হয়েছে।”পরিস্থিতি বোঝাতে গিয়ে যখন-তখন বিচারপতিদের সরিয়ে দেওয়া হতো বলেও মন্তব্য করেন তিনি।“আজকে আপনাকে পছন্দ হচ্ছে না, কালকে আপনি যান, এই একটা পর্যায় ছিলো।” আইনমন্ত্রী বলেন, একটি বেশ দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় আইনটাকে এ পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে; যার সবখানেই অভিযুক্তের সুরক্ষা রয়েছে। এখন যদিকেউ কোনো মিথা অভিযোগ করে, যদি প্রমাণিত হয়, সেটা মিথ্যা তাকেও শাস্তি পেতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে কোনো অভিযোগহলে বিচারকের শাস্তি না হলে অভিযোগকারীর শাস্তি হবে। সরকারের তরফ থেকে কেউ অভিযোগ করলে তা প্রমাণিত না হলে তাকেও এই শাস্তি পেতে হবে বলে জানান আইনমন্ত্রী।সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলাকালে এ আইন করার উদ্যোগ ঠিক ছিল কি না- এমন প্রশ্নে আনিসুল হক বলেন, “মামলার শুনানিকালে এই আইনে খসড়া সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে দিয়েছি। এটা কারও অজানা না। ওই বিচারকরাএই আইন করতে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেন নাই।”আইনে বিচারকদের মতামত নেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু যেহেতু তাদের ব্যাপার, তারাই একমাত্র স্টেক হোল্ডার,তারা জনসম্মুখে এটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন না। আমি মনে করি, তাদের অভিমত নেওয়াটা বাঞ্ছনীয়।”যে কোনো নাগরিক অভিযোগ করতে পারবেন- আইনমন্ত্রীএকথা জানানোর পর এক সাংবাদিক জানতে চান, সরকার কোনো অভিযোগ করতে পারবে কি না? জবাবে তিনি বলেন, “সকল নাগরিক পারবে। তার মানে কি? আমি নাগরিকের বাইরে?”সরকারের কোনো পর্যায় থেকে অভিযোগ করার পর তা মিথ্যা প্রমাণিত হলে কে সাজা পাবে- এমন প্রশ্নে আনিসুল হক বলেন, “সরকারের মাধ্যমে করলেও তো কোনো ব্যক্তিকে করতে হবে। হি হ্যাজ টু রিপ্রেজেন্ট। তার নাম থাকবে। দায়িত্ব নিয়ে কাজটা করতে হবে। সেই ব্যক্তি সাজাটা নিবে। “এটাতো পরিষ্কার। যখন কেউ অভিযোগ করবে,সে যেই হোক না কেন, তাকে এইটুকু দায়িত্ব নিতে হবে। অভিযোগ মিথ্যা হলে তাকে শাস্তি পেতে হবে।”ষোড়শ সংশোধনীর একটা বিধানের আলোকে এ আইন করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সেটার উপর নির্ভর করেই তো এই আইন। আদালত সেই সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করলে এই আইন থাকবে না।”