ননী ও তাহেরের মৃত্যুদণ্ড

5_8534

একাত্তরে হত্যা, অপহরণ, অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধের দায়ে নেত্রকোনার মো. ওবায়দুল হক তাহের ও আতাউর রহমান ননীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বা ফায়ারিং স্কোয়াডে (গুলি করে) তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মঙ্গলবার এ রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দী। রায়ে আসামি তাহের ও ননীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ছয়টির মধ্যে চারটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে মশরফ আলী তালুকদারসহ ৭ জনকে গুলি করে হত্যা সংক্রান্ত তিন নম্বও এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বদিউজ্জামান মুক্তাসহ ৬ জনকে অপহরণের পর হত্যা সংক্রান্ত পঞ্চম অভিযোগে তাদের দেয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। রায়ে বলা হয়েছে, যে বর্বর ও নৃশংস অপরাধ তারা ঘটিয়েছে এর মাত্রা ও ধরন বিবেচনায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো সাজা উপযুক্ত হবে না। রায়ে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী দুই আসামির মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে রাখতে অথবা গুলি চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যার ব্যাপারে রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, পাক দখলদার বাহিনীর কাছ থেকে দেশকে মুক্ত করতে বাঙালি জাতি ও মুক্তিযোদ্ধারা নয় মাস যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। লাখ লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এক কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস এখন অবিতর্কিতভাবে জাতির পবিত্র আবেগ ও মুক্তিযুদ্ধের অহংকারের সঙ্গে মিশে আছে। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক চলাবস্থায় ট্রাইব্যুনাল তার পর্যবেক্ষণে একথা বলেন।

এছাড়া এক ও দুই নম্বর অভিযোগে হত্যা, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আসামিদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় তাদের আমৃত্যু কারাভোগের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। চতুর্থ অভিযোগে হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা এবং ষষ্ঠ অভিযোগে গণহত্যার ঘটনায় দুই আসামির সংশ্লিষ্টতা প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে না পারায় তাদের খালাস দেয়া হয়েছে।

রায়ের পর প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, ‘রায় প্রদানকালে আদালত বলেছেন মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। এ রায়ের মধ্য দিয়ে শহীদ পরিবারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। এ রায় শহীদ পরিবারের জন্য স্বস্তি ও সান্ত্বনা। দীর্ঘ সময় পর হলেও ন্যায়বিচার পেয়েছে শহীদ পরিবারগুলো।’ মামলার প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল সাংবাদিকদের বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এ আসামিদের দ্বারা যেসব নৃশংস অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তাতে তাদের মৃত্যুদণ্ডের সাজাই প্রাপ্য বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা জানিয়েছেন ননী ও তাহের। রায়ের পর তাদের আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছেন, তাতে তারা সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করার কথা জানিয়েছেন। আপিলে তারা ‘নির্দোষ’ প্রমাণিত হয়ে খালাস পাবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন এই আইনজীবী।

গাজী তামিম আরও বলেন, ‘যে চার অভিযোগে তাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, সবগুলোতে তারা খালাস পাওয়ার যোগ্য। ১৯৭১ সালে আতাউর রহমান ননী অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিলেন। একজন অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর পক্ষে এত বড় জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকা একেবারেই অস্বাভাবিক বলে আমরা মনে করি। আরেকজন (তাহের) ডিগ্রির ছাত্র ছিলেন। একজন সাক্ষীর বয়স তখন ছিল এক বছর, অন্যজনের বয়স তিন বছর ছিল। নেত্রকোনায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা, অনেক বয়স্ক লোক ছিল। তাদের না এনে প্রসিকিউশন এ রকম মাইনরদের (ছোটদের) এনে সাক্ষী বানিয়েছে।’ রায়ের জন্য দুই যুদ্ধাপরাধীকে সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয়। সাড়ে ১০টার পর তাদের কাঠগড়ায় তুলে পড়ে শোনানো হয় ২৬৮ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসার। পরে ট্রাব্যুনালের চেয়ারম্যান সাজা ঘোষণা করেন।

মামলা ইতিহাস : এই মামলার অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ওবায়দুল হক তাহের নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার ভোগাপাড়ার শুনই এলাকার মঞ্জুরুল হকের ছেলে। তার জন্ম ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি। বিকম ডিগ্রি পাওয়ার পর তাহের নেজামী ইসলামী পার্টির রাজনীতিতে যোগ দেন। এ দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রাম শুরু হলে তিনি তার বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় গঠিত রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে নেত্রকোনা সদরের কমান্ডারের দায়িত্ব পান। আরেক যুদ্ধাপরাধী আতাউর রহমান ননী একই জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কচন্দরা এলাকার মৃত আহছান আলী ওরফে আছান আলী ওরফে হাছেন আলীর ছেলে। এসএসসির সনদে ননীর জন্মতারিখ ১৯৫৬ সালের ৭ জুলাই উল্লেখ করা হলেও জাতীয় পরিচয়পত্রে লেখা হয়েছে ৮ আগস্ট ১৯৫৮। পৌর শহরের সাবেক এই ফুটবলারও একাত্তরে তাহেরের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন।

নেত্রকোনার মুক্তিযোদ্ধা আলী রেজা কাঞ্চন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১০ সালে ননী ও তাহেরসহ ১২ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন। পরে বিষয়টি যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালে আসে। ২০১৩ সালের ৬ জুন এ দুই আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত সংস্থা। এক বছর চার মাস ২৮ দিন তদন্তের পর ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর ৬৩ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। ২০১৪ সালের ১২ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। ওইদিন বিকালে শহরের মোক্তারপাড়ার সাবেক ফুটবলার ননী ও তেরীবাজারের ব্যবসায়ী তাহেরকে গ্রেফতার করে নেত্রকোনা মডেল থানা পুলিশ। পরে তাদের ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। পরদিন হাজির করা হলে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে তদন্ত সংস্থা। এরপর একই বছরের ১১ ডিসেম্বর ননী-তাহেরের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর গত বছরের ২ মার্চ এ দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়। ননী-তাহেরের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৩ জন সাক্ষী। অপরদিকে আসামিদের পক্ষে একজন সাফাই সাক্ষীর নাম দেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তাকে হাজির করা হয়নি। ৪ জানুয়ারি থেকে চার দিন দু’পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে।

২২তম রায় : ননী-তাহেরের রায়টি ছিল যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালের ২২তম মামলার রায়। ২২ মামলায় এ পর্যন্ত ২৬ জন দণ্ডিত হয়েছেন। এর মধ্যে তাহের ও ননীকে নিয়ে মোট ১৯ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে। এর আগে যাদের ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে তারা হলেন, জামায়াত নেতা আবুল কালাম আজাদ। এছাড়া জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। পরে আপিল বিভাগের রায়ে তিনি আমৃত্যু কারাভোগের আদেশ পান। অন্যদিকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা যাবজ্জীবন পেলেও আপিলের রায়ে তিনি মৃত্যুদণ্ড পান এবং পরে তা কার্যকর হয়। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামন, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। ফাঁসির সাজা নিয়ে পালিয়ে আছেন চৌধুরী মঈনউদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খান। জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীকে ট্রাইব্যুনাল ফাঁসির আদেশ দেন যা আপিল বিভাগ বহাল রেখেছেন। বর্তমানে তার ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষা। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাসেম আলীর আপিল শুনানির অপেক্ষায়।

এছাড়া ফরিদপুরের নগরকান্দার বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন খোকন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেন, জাতীয় পার্টির নেতা সৈয়দ মো. কায়সার, জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম, দলটির নায়েবে আমীর আবদুস সোবহান, সৈয়দ মো. হাছান আলী, পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিক ও শেখ সিরাজুল হককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের রায়ে আমৃত্যু কারাভোগের রায় পেয়ে মারা যান জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযম ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীম। মাহিদুর রহমান, আফসার হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বার ও খান আকরাম হোসেনকে আমৃত্যু কারাভোগের রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

আনন্দ মিছিল : ননী-তাহেরের প্রাণদণ্ড হওয়ায় নেত্রকোনার মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছেন। জেলা শহরের মোক্তারপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের সামনে মুক্তিযোদ্ধারা জড়ো হয়ে রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। রায়ের খবর আসার পরপরই তারা আনন্দ মিছিল বের করেন। মিছিলটি মোক্তারপাড়া সড়ক ঘুরে আবার মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের সামনে এসে থামে। পরে রায়ে সন্তোষ জানিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. নুরুল আমিন, মামলার বাদী আলী রেজা কাঞ্চন, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হালিম প্রমুখ।