এজন্য কোনো হতাশা বা আক্ষেপ নেই-পূর্ণিমা
প্রিয় পাঠক, চলুন আপনাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাই ২০০৪ সালে। ওই বছর ভারত বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার একটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। ছবির গল্পে তেমন আহামরি কোনো চমক ছিল না। আট দশটা সিনেমার মতো এরও সাদামাটা একটি গল্প ছিল। কিন্তু অসাধারন নির্মান, কারিগরি মুন্সিয়ানা আর অভিনেতা অভিনেত্রীর চমৎকার অভিনয় সৌকর্যের কারনে ছবিটি ওই বছর দারুন ব্যবসা করেছিল। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বড় একটি জায়গা দখল করে আছে ছবিটি। অনেকেই হয়তো ছবির নাম মনে করতে পারছেন না তাই তো? শুনুন তাহলে মতিউর রহমান পানু পরিচালিত ছবিটির নাম ‘মনের মাঝে তুমি’। নায়ক রিয়াজের বিপরীতে ছবিতে শানত্ম স্নিগ্ধ সহজ সরল বড়লোক কন্যার চরিত্রে অসাধারন অভিনয় করেছিলেন পূর্ণিমা।
১৯৯৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত ‘এ জীবন তোমার আমার’ পূর্ণিমা অভিনীত প্রথম ছবি। ছবিটি ব্যবসা সফলও। এই ছবি তাকে নায়িকা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিলেও ‘মনের মাঝে তুমি’ যেন পূর্ণিমার ক্যারিয়ারে ভরা পুর্ণিমার মতো আলো ছড়িয়েছে ভারত বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে। সেই আলোর ঝলকানি এখনো পূর্ণিমাকে উদ্ভাসিত করে যাচ্ছে। একটানা ছয়টি মাস ‘মনের মাঝে তুমি’ পুরো বাংলাদেশে অবিরাম ভাবে সিনেমা হলে হাউস ফুল হয়েছে। মনের মাঝে তুমি গানটি এ দেশের মাঠে, ঘাটে, হাটে, বাজারে. রেসেত্মারায় মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। মূলত তখন থেকেই পূর্ণিমা আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর আসন শক্ত ও পোক্ত করেছেন। ২০০৪ এর পর আরো বেশ কিছু ভালো ছবিতে অভিনয় করে নিজের জনপ্রিয়তা, চাহিদা ও ক্যারিয়ার শানিত করেছেন। এসএ হক অলিকের পলিচালনায় রিয়াজ প্রযোজিত ও অভিনীত হৃদয়ের কথা, আকাশ ছোয়া ভালোবাসা পূর্ণিমাকে জনপ্রিয়তার মধ্য গগনে তুলে দেয়। শুধু বানিজ্যিক ধারায় নয় তিনি সাহিত্য নির্ভর ছবিতেও সাবলিল অভিনয় করে তার প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছেন। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছবি ‘মেঘের পরে মেঘ’ এবং সাহিত্য নির্ভর ছবি ‘শাসিত্ম’ ও ‘সুভা’য় অভিনয় করে বোদ্ধা দর্শকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছেন। এতো জনপ্রিয়তা, দর্শকদের অফুরনত্ম ভালোবাসা, ব্যাপক চাহিদা এসব কিছু তালুবন্দি করে হঠাৎই কাউকে কিছুনা বলে কোথায় যেন হারিয়ে যান পূর্ণিমা। ২০১২ থেকে ২০১৬ দীর্ঘ তিনটি বছর তিনি স্বেচ্ছায় নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। ২০১২ সালে তার সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’।
তবে বিরতির এই তিন বছরে যে তিনি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াননি তা নয়। তিনি মাঝে মধ্যে বিশেষ কিছু টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন, বিজ্ঞাপনেও কাজ করেছেন। শুধুমাত্র মিডিয়ার সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। একটা সময় তিনি ঢাকা ছেড়ে স্বামী সনত্মান নিয়ে চট্টগ্রামে বসবাস শুরু করেন। ওই সময় মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে তার সকল যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল।
বিরতির তিনটি বছর অগণিত ভক্ত দর্শক তাকে পর্দায় দেখার আকুতি জানিয়ে আসছিল। দর্শকদের কথা ভেবে নির্মাতারা তাকে নিয়ে কাজ করার প্রানানত্মর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০১৫ সালে তার ফেরার কথা ছিল কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যনত্ম ২০১৬ সালের এপ্রিলে এসে তিনি অভিনয়ে সরব হওয়ার ঘোষনা দেন। সর্বশেষ তপুখানের পরিচালনায় ‘গোপনে’ নামের একটি নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ণিমা ফিরে এলেন মিডিয়ায়। উত্তরার একটি শুটিং হাউজে শুটিংএর ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় পূর্ণিমার সঙ্গে। অভিনয়ে তাঁর বিরতি দেয়া, আবার ফিরে আসা, নাটক সিনেমা সহ নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন।
এমন কি হয়েছিল যে দীর্ঘ বিরতি নিলেন?
পূর্ণিমা: তেমন কিছুনা। সম্পূর্ন পারিবারিক কারনেই বিরতি নিতে হয়েছিল। তবে সম্পূর্ণ বিরতি বলা যাবে না। মাঝে মধ্যেই নাটক, বিজ্ঞাপনচিত্র ও মোটিভেশনাল চলচ্চিত্রে কাজ করতে হয়েছে। শুধু মূল স্রোতের ছবিতে কাজ করা হয়নি। এই বিরতি নেয়ার অন্যতম কারন হলো আমার মেয়ে উমাইজা। ছোট্ট উমাইজাকে রেখে কাজে ব্যসত্ম হওয়াটা আমার কাছে সঠিক মনে হয়নি। আমি মনে করি জন্ম নেয়ার পর সনত্মানের অনত্মত ৩/৪ বছর মায়ের সান্নিধ্য পাওয়া জরুরি। এখন আমার মেয়ের বয়স ৪ বছর হয়েছে এখন ওকে রেখে কাজ করলে সমস্যা হবে না।
ফিরে এসে কাজ করার অনুভূতি কেমন?
পূর্ণিমা: এই অনুভূতি নতুন নয়। তবে বর্তমান অনুভূতি অন্যরকম। এখন নাটকের অনেক ভেরিয়েশন এসেছে। গল্প মেকিং সব কিছুতেই নতুনত্ব আছে। তাছাড়া তরুন অনেক ভালো নির্মাতা কাজ করছে তাদের নিত্য নতুন চিনত্মাধারায়। সব কিছু মিলিয়ে টিভি নাটকের পরিবেশ চমৎকার।
একটা সময় প্রচন্ড ব্যসত্ম ছিলেন সিনেমার কাজ নিয়ে। লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন কথা গুলো শুনতে হতো প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি। বিরতির সময় এসব মিস করতেন না?
পূর্ণিমা: আমি আসলে সব সময় বলতে পারেন নাটক সিনেমা ও বিজ্ঞাপন চিত্রের মানুষদের সংস্পর্শে ছিলাম। তবে চলচ্চিত্রে একসময় যে দূর্দানত্ম ব্যসত্ম ছিলাম সেই দিন গুলোর কথা অবশ্যই মনে পড়েছে। এজন্য আমার মধ্যে কোনো হতাশা বা আক্ষেপ নেই। কারন আমি জানি চলচ্চিত্রে আমি খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করব।
গত কয়েক বছরে আমাদের চলচ্চিত্রের চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে বিশেষ করে নতুন এবং তরুণদের হাত ধরে চলচ্চিত্র নতুন গতি পেয়েছে। পরিবর্তিত এই সিনেমা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিবেন কি ভাবে?
পূর্ণিমা: আমাদের চলচ্চিত্রের ম্যাসিভ একটা পরিবর্তন খুবই জরুরি। সেটা যদি তরুণদের বা নতুনদের হাত ধরে হয় তবে সেটাই হবে আসল কাজ। আগেই বলেছি আমি কিন্তু একেবারে নির্বাসনে যাইনি। শুধুমাত্র বিরতিতে ছিলাম। আমার কাজ তো অভিনয় করা। একজন সৃজনশীল শিল্পী চাইলে সবার সঙ্গে সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।
বিরতির সময় অবারিত অবসর কি ভাবে কেটেছে?
পূর্ণিমা: আমার বই পড়ার অভ্যাস আছে। পত্র-পত্রিকা, গল্প উপন্যাস পড়া এবং টুকটাক লেখার অভ্যাসও আছে। হাতের কাছে সব সময় আমার একটা নোটবই থাকে। যখন যা মনে হয় তাই লিখে রাখি। নাটকের অনেক প্লট আছে আমার কাছে। কেউ যদি আমার গল্প বা স্ক্রীপ্ট নিয়ে নাটক করতে চায় তাহলে লিখে দিতে পারি। এ ছাড়া মেয়েকে নিয়ে হাসি আনন্দে সময় কেটেছে আমার।
মূলধারার চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন কবে থেকে? এরই মধ্যে কার কার সঙ্গে কথা হয়েছে?
পূর্ণিমা: গত কয়েক মাসে অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে। কারো সঙ্গে ফাইনাল কোনো কিছু হয়নি। তবে অভিনেতা শাহরিয়ার নাজিম জয় ভাই একটি ছবি করছেন ‘বন্ধ দরজা’ নামে। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত এই ছবিটি করার ব্যাপারে ফাইনাল কথা হয়েছে। এছাড়া দেখে শুনে তারপর ছবি সাইন করতে চাই। হুট করে কিছু করব না।
আমাদের চলচ্চিত্রের অবস্থা এখন কেমন বলে মনে হয়?
পূর্ণিমা: আমাদের সিনেমার অবস্থা আসেত্ম আসেত্ম ভালো হচ্ছে। নিত্য নতুন গল্প, তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর ছবি করার চেষ্টা করছে নতুনরা। নিত্য নতুন গল্পের দিকে আমাদের মনযোগ দিতে হবে। পুরনো ধ্যান ধারনা বাদ দিতে হবে। নতুন প্রজন্মের দশর্কদের সিনেমা হল মুখী করতে হবে। কারন আমাদের তরুণ দর্শকরা সিনেমা বিমুখ হয়েছে।
আপনি তো সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে অটিষ্টিক শিশুদের নিয়ে নির্মিত দু’টি ছবিতে অভিনয় করেছেন?
পূর্ণিমা: আমি মনে করি সবারই অটিষ্টিক শিশুদের পাশে দাঁড়ানো উচিৎ বিশেষ করে শিল্পীদের। ওদের এই অবস্থার জন্য ওরা এবং পিতা মাতারা তো দায়ী নয়। আমরা সবাই যদি ওদের সহযোগিতা করি তাহলে এই সমাজে ওরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করার অনুপ্রেরনা পাবে। ইতিমধ্যে আমি অনন্য মামুনের অসিত্মত্বও সাইফুল ইসলাম মান্নুর ‘পুত্র’ এই দু’টি ছবিতে অভিনয় করেছি। খুব তাড়াতাড়ি ছবি দু’টি মুক্তি পাবে।
আপনার পরিবারের কথা বলুন?
পূর্ণিমা: আমার মেয়ে উমাইজাকে নিয়েই পরিবারের হাসি আনন্দ। আমার স্বামী আহমেদ ফাহাদ জামাল একজন ব্যবসায়ী। গত কয়েকটি বছর চট্টগ্রামে থেকেছি এখন ঢাকায় আছি।
টিভি নাটকে অভিনয় করাকে অনেক চলচ্চিত্র তারকা পছন্দ করেন না। আপনি এটাকে কি ভাবে দেখেন?
পূর্ণিমা: অভিনয় তো অভিনয়ই। আমার কাছে টিভি হোক আর চলচ্চিত্রই হোক অভিনয়ের ক্ষেত্রে কোনো ভেদাভেদ নেই। অনেকেই হয়তো ভেদাভেদ খোঁজেন কিন্তু আমি খুঁজি না। একজন পেশাদার শিল্পীর এই মনোভাব থাকা উচিৎ নয়।