আটকে আছে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার নতুন উদ্যোগ
গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েও এগুতে পারছে না সরকার। ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের সব উদ্যোগ কৌশলে আটকে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারের পক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া নানা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্থগিত চেয়ে রিট পিটিশন হচ্ছে উচ্চ আদালতে। এর ফলে আটকে যাচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের যাবতীয় উদ্যোগ। গ্রামীণ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, মামলা জটিলতায় গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা যাচ্ছে না। একই কারণে আটকে আছে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ প্রক্রিয়াও। ফলে ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে চলছে ব্যাংকিং কার্যক্রম। একইসঙ্গে ব্যাংকের চেয়ারম্যান খন্দকার মোজাম্মেল হক পদত্যাগ করলেও ওই পদে নতুন কাউকে নিয়োগ দিতে পারছে না সরকার। অভ্যন্তরীণ নানা জটিলতা থাকায় কেউ এ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে আসতেও চাইছেন না। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বেশ কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কাউকে চেয়ারম্যান পদে রাজি করাতে পারেননি।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের ৯টি পদ শূন্য হলেও এই পদগুলোয় পরিচালক নির্বাচন করতে পারছে না সরকার। প্রতি তিনমাস পর পর একবার বোর্ড মিটিং করার বিধান থাকলেও ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত বোর্ড পরিচালকদের কোনও সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। বিদায়ী পরিচালকরা শুরু থেকেই সংশোধিত গ্রামীণ ব্যাংক আইন ২০১৩’র বিরোধিতা করে আসছেন। পরবর্তী সময়ে গত ৫ আগস্ট সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। পদত্যাগপত্রে তিনি অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে দায়িত্ব পালনে অপরাগতা প্রকাশ করেছেন। অর্থমন্ত্রী তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে নতুন চেয়ারম্যান দায়িত্বভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাকে এ পদে থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন।
এদিকে, আদালতে মামলা থাকায় সরকার আগে থেকেই এমডি নিয়োগ দিতে পারছে না। পরিচালক নির্বাচনের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক নির্বাচন বিধিমালা ও সংশোধিত গ্রামীণ ব্যাংক আইন ২০১৩ অনুসারে একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজের নেতৃত্বে নির্বাচন পরিচালনা কমিশন গঠনের কথা বলা থাকলেও এই দায়িত্ব পালন করতে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ খুঁজে পাচ্ছে না সরকার। কোনও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এ দায়িত্ব পালনে আগ্রহ প্রকাশ করছেন না। অর্থমন্ত্রী নিজে বেশ কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারাও এ দায়িত্ব নিতে অর্থমন্ত্রীর কাছে অপরগতা প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, সরকার বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার জন্য সরকার তিনজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাকে নিযুক্ত করেছে। তারা হলেন, গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান খন্দকার মোজাম্মেল হক, ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পাওয়া প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব সুরাইয়া বেগম এবং আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার। বোর্ডের চতুর্থ সদস্য হলেন ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম মহিউদ্দিন। তিনি বোর্ড সদস্য না হলেও সব বোর্ড সভায় অংশগ্রহণ করছেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের ২ হাজার ৫০০ শাখায় মোট ৮০ লাখ ৪০ হাজার ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে তাদের মনোনীত প্রতিনিধি বের করে আনতে নির্বাচনের কৌশল পরিবর্তনের কথাও ভেবেছিল সরকার। কারণ এই বিপুল সংখ্যক সদস্যদের নিয়ে নির্বাচন করতে গেলে তা রাজনৈতিক নির্বাচনের রূপ ধারণ করতে পারে। এলাকার রাজনৈতিক নেতারা এ নির্বাচনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে পারেন। এর ফলে জয়পরাজয় নিয়ে হাঙ্গামা সৃষ্টি হতে পারে। তাই সরাসরি ভোটাভুটিতে না গিয়ে প্রতিটি এলাকায় উঠান বৈঠকের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতাদের প্রতিনিধি মনোনয়ন করা যায় কি না—বিষয়টি নিয়েও সরকারের সংশ্লিষ্টরা চিন্তাভাবনা করেছিলেন বলে জানা গেছে।
১৯৮৩ সালে এইচএম এরশাদের শাসন আমলে সামরিক অধ্যাদেশের অধীনে গঠিত ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অবসরের মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পরও পদে থাকার কারণ দেখিয়ে ২০১১ সালের ২ মার্চ গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব থেকে ড. ইউনূসকে অব্যাহতি দেয় সরকার। এর বিরুদ্ধে ড. ইউনূস উচ্চ আদালতে গেলেও রায় তার বিপক্ষে যায়। তখন থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডির পদটি খালি রয়েছে। চলছে ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে।
গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক নির্বাচনে গত ২০১৫ সালের ৬ এপ্রিল বিধিমালা জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বিধিমালায় পরিচালক নির্বাচনের জন্য ছয় মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়, যা গত ৫ অক্টোবর শেষ হয়েছে।
গ্রামীণ ব্যাংকের বিদায়ী ৯ নারী পরিচালক হলেন, ময়মনসিংহের তাহসিনা খাতুন, সিলেটের মোছা. সুলতানা, চট্টগ্রামের সাজেদা, কুমিল্লার রেহানা আক্তার, গাজীপুরের সালেহা খাতুন, দিনাজপুরের পারুল বেগম, বগুড়ার মারিনা, যশোরের শাহিদা এবং পটুয়াখালীর মমেনা বেগম।
গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ৯ নারী পরিচালকদের মেয়াদ শেষ হওয়া প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছেন, যাদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তারা তো সাবেক হয়ে গেছেন। তাদের বিষয় আবার আসছে কেন?
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ও ময়মনসিংহের প্রতিনিধি তাহসিনা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পরিচালকদের মেয়াদ শেষ হওয়ার বা পদ শূন্য হওয়ার কোনও বিষয় নেই। নতুন পরিচালক নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদেরই পরিচালকের দায়িত্ব পালন করার কথা। কিন্তু সরকার আমাদের সে সুযোগ দিচ্ছে না।
এদিকে, ২০০৬ সালে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন তৈরির প্রচেষ্টার জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসও নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। বর্তমানে ব্যাংকটির প্রায় ২৫ শতাংশ শেয়ার সরকারের। ২০১৩ সালের আগস্ট মাসের আগে সরকারের এই অংশ ছিল মাত্র ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. আসলাম আলম বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, গ্রামীণ ব্যাংক আইন ও বিধিমালা অনুসারেই চলছে। কিছু কার্যক্রমের ওপর আদালতের মামলা রয়েছে, সে কারণে এগুনো যাচ্ছে না।