পুঁজিবাজারে ক্রেতা কম বিক্রেতা বেশি

9e1f38e6cc2bcedcee6f37c51180b885-

দেশের পুঁজিবাজারে বড় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও সাহস করে আর আসছে না। শেয়ার কিনতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও কোনও আগ্রহ নেই। বরং শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ছে। দীর্ঘ মন্দার আশঙ্কায় পুঁজি নিরাপত্তায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করছেন। আবার অনেকেই কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পেয়ে শেয়ার কেনাবেচা থেকে বিরত রয়েছেন। এসব কারণেই আস্থাহীন পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।  আস্থাহীনতার আরেকটি কারণ, পুঁজিবাজারে নতুন যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে, এরমধ্যে অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর দামের নিচে নেমে যায়।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টার প্রেস নেটওয়ার্কের (আইপিএন) সিনিয়র গবেষক আনোয়ারুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আস্থার সংকটের কারণে নতুন বিনিয়োগকারীরা বাজারে আসছেন না। আবার পুরনো বিনিয়োগকারীদের বড় একটি অংশের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব ঋণভারে জর্জরিত। ফলে এসব হিসাবে কোনও লেনদেন হচ্ছে না। তিনি বলেন, শেয়ার বিক্রি করেও লাভ না পাওয়ার কারণে অনেকে বেচাকেনা থেকে দূরে রয়েছেন। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এখনও কারসাজির ভয় রয়েছেই। এছাড়া ২০০৯ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এই বাজারে ঝাঁপিয়ে পড়লেও এখন তার কোনও ভূমিকা রাখছে না। এ কারণে এই বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।
বাজারের দৈনন্দিন লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ডিএসইতে লেনদেন উঠেছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকায়। কমতে কমতে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে সেটি নেমে আসে সর্বনিম্ন ১০১ কোটি টাকায়। ২০১৪ সালে ডিএসইতে দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। সদ্য বিদায়ী ২০১৫ সাল শেষে দৈনিক গড় লেনদেন আরও কমে নেমে এসেছে ৪২২ কোটিতে।  এখন সেই সূচক সাড়ে ৪ হাজার পয়েন্টকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ ২০১০ সালের পর গত পাঁচ বছরে ৭০টির বেশি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। তাতেও সূচকের খুব বেশি উন্নতি হয়নি।

এদিকে টানা আট দিন ধরে সূচক কমছে দেশের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই)। আট দিনে ১৫৭ পয়েন্ট সূচক কমেছে ডিএসইতে। এই বাজারে সূচক দেড় মাসের মধ্যে এখন সবচেয়ে নিচে অবস্থান করছে। রবিবার ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ৩৩ পয়েন্ট কমে চার হাজার ৫৪১ পয়েন্ট হয়েছে।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পুঁজিবাজারে চাঙ্গাভাব দেখা যায়। ওই সময় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে পরিচিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ বাড়ে। পাশাপাশি অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীরাও সক্রিয় ছিলেন। ফলে বাজারে মূল্যসূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা তৈরি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ কমানোর চাপ সৃষ্টি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর থেকেই পুঁজিবাজারে ব্যাংকের অংশগ্রহণ কমে যায়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে লেনদেনে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে, লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পুঁজি  হারিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন।

আইপিএনের গবেষণা অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে কেবল ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাই লোকসানে পড়েনি, কয়েকটি ব্যাংকও লোকসান দিয়েছে। আর এই লোকসান কমাতে নতুন করে শেয়ার কেনার কারণে ২ ডজন ব্যাংককে শোকজ ও জরিমানা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট কেটে গেলেই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, হঠাৎ করে দরপতনের মতো পারিপার্শ্বিক কোনও অবস্থা সৃষ্টি হয়নি।

ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের একজন রাজধানীর মীরহাজির বাগের ওমর ফরুক। তার কাছে পুঁজিবাজার চরম মানসিক যন্ত্রণার নাম। কারণ, তিনি  পুঁজিবাজারে ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ৮ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছেন। শেয়ারের দাম আর একটু বাড়লে তিনি লোকসান হলেও বাজার থেকে বেরিয়ে আসবেন। তার মতে, পুঁজিবাজারের এই যন্ত্রণার মধ্যে না থেকে বরং এই টাকা অন্য কোথাও বিনিয়োগ করাই নিরাপদ।

শুধু ওমর ফারুকই নন, তার মতো লোকসান দেওয়া কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করার জন্য অপেক্ষা করে চলেছেন। এতে এই বাজারে শেয়ার বিক্রির চাপ কেবলই বাড়ছে। অথচ শেয়ারের দাম যে পর্যায়ে নেমে এসেছে, তা বিনিয়োগের জন্য খুবই আকর্ষণীয়। তারপরও ক্রেতা নেই বাজারে।

আস্থার সংকটের কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আস্থার সংকটের কারণে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।  তিনি জানান, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। এ অবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর আস্থা ফেরাতে বিএসইসিকে নতুন করে ঠেলে সাজানোর পরামর্শ দেন তিনি।

তবে আগামী কিছু দিনের মধ্যেই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করেন, ডিএসইর সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আগামী দু-একদিন পরই হয়তো বাজারের অবস্থার উন্নতি হবে। একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও আসাকে কেন্দ্র করে বাজার কিছুটা চাপে থাকলেও কিছু দিন পরই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ধসের পর বাজারে আস্থা ফেরাতে দেওয়া হয়েছে অনেক প্রণোদনা। গত পাঁচ বছরের আইনকানুন, বিধিবিধান থেকে শুরু করে অনেক পরিবর্তনই হয়েছে। কারসাজি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারে গঠন করা হয়েছে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। পুনর্গঠন করা হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এতসব পরিবর্তনের পরও বাজার নিয়ে হতাশ বিনিয়োগকারীরা। শুধু বিনিয়োগকারীরাই নয়, স্বস্তিতে নেই পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরিজীবীরাও। শেয়ার কেনাবেচা কমে যাওয়ায় ব্রোকারেজ হাউসগুলোর আর্থিক অবস্থা ভালো না। খরচ কমাতে চাকরি ছাঁটাইয়ের পথ বেছে নিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান।

এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন ল্যাবের (আরআইএল) বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঝুঁকির মাত্রা ও বিক্রির অতিরিক্ত চাপ থাকার কারণে এই বাজারে নিম্নমুখী প্রবণতার সৃষ্টি হয়েছে। আরআইএল বলছে, আগের সপ্তাহের তুলনায় গড় বাজার মূলধন হ্রাস পেয়েছে ০.৪৮%; আর বাজার মূলধন হ্রাসের সঙ্গে হাওলা ২০.৮৮% ও লেনদেনের পরিমাণ কমেছে ২৬.৮৪%। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি তাদের পর্যবেক্ষণে বলছে, গত সপ্তাহে অনেক বিনিয়োগকারীরা প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ও লেনদেনে অংশ না নিয়ে বাজার পর্যবেক্ষণ করেছেন। মূলতঃ বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির সম্ভাব্য প্রভাব এবং গণমাধমে সাম্প্রতিক পুঁজিবাজার সম্পর্কিত নানা বক্তব্যের কারণে বিনিয়োগকারীরা এমন অতি-সাবধানী অবস্থানে চলে গেছেন বলে তাদের ধারণা।

সংস্থাটির পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীরা খুব বেশি সুবিধা করতে পারেননি। সপ্তাহজুড়ে গড়ে প্রতি ইউনিট ঝুঁকি নেওয়ার বিপরীতে মুনাফার পরিবর্তে বিনিয়োগকারীদের লোকসান গুণতে হয়েছে। প্রতি ১ ইউনিট ঝুঁকির বিপরীতে এই লোকসানের পরিমাণ ১.৬৮, যা এর আগের সপ্তাহের তুলনায় প্রায় ৮ গুণ বেশি।

এদিকে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকের মোট শেয়ার ধারণ ছিল মূলধনের ৫৯ শতাংশ, যা বাজারমূল্যের প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের নভেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ নেমে এসেছে ২৩ হাজার কোটি টাকা, যা মোট মূলধনের ৩৪ শতাংশ। বর্তমান এই বিনিয়োগ আরও কমে গেছে।

কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের কারণে ব্যাংকগুলো বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছে না। আবার মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজের মাধ্যমে যে পরিমাণ বিনিয়োগ ছিল পুঁজিবাজারে মন্দার কারণে ওইসব ঋণ দীর্ঘ দিন ধরে আদায় না হওয়ায় তা এখন মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন সংরক্ষণের পরিমাণ বেড়ে গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ২০১০ সালের যেখানে একটি ব্যাংক দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারত, এখন দেড় শ’ থেকে দুই শ’ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও  নির্বাহী পরিচালক শুভাঙ্কর সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। এছাড়া  কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতিতেও পুঁজিবাজারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীরা ফিরলেই পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে।