ক্রেতার হুড়োহুড়িতে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম
ভরা মৌসুমেও বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। স্বাভাবিক নিয়মে অন্যান্য বছর এই সময়ে পেঁয়াজের দাম সবচেয়ে কম থাকলেও এবছর এর ব্যত্যয় ঘটেছে। ভরা মৌসুমে পেঁয়াজের দাম কমতে না কমতেই আবার বাড়তে শুরু করেছে।
এবছর দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ভালো হয়েছে। বাজারে পেঁয়াজ সরবরাহের ক্ষেত্রেও কোনও জটিলতা নেই। ভারত থেকে প্রতিদিন স্বাভাবিক নিয়মেই ৬০ থেকে ৬৫ ট্রাক পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। এরপরও পেঁয়াজের এই মূল্যবৃদ্ধির জন্য ক্রেতার হুড়োহুড়িকে দায়ী করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, রমজান এলেই পেঁয়াজ কেনার জন্য ক্রেতারা অহেতুক হুড়োহুড়ি করেন। একবারে অনেক বেশি পেঁয়াজ কিনে জমা করে রাখেন। বাজারে পেঁয়াজের সংকট নেই জেনেও তাদের এমন হুড়োহুড়ির প্রভাব পড়ে বাজারে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৭ থেকে ৪৯ টাকা দরে। ফরিদপুরের হাইব্রিড পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৫ টাকা আর ভারতীয় আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা দরে। রাজধানীর শ্যামবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক খান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, এই ভরা মৌসুমে কোনোভাবেই পেঁয়াজের কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এখন খুচরা বাজারে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৯ টাকা দরে।
চাহিদার কারণে রমজানে পেঁয়াজের দাম বাড়ে, যা এখন অনেকটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে দেশে পেঁয়াজের কোনও ঘাটতিও নেই। তাই মূল্যবৃদ্ধিরও কোনও কারণ নেই।
ক্রেতার চাপে কীভাবে পণ্যের দাম বাড়ে তার একটি ব্যাখ্যা দিলেন শ্যামবাজারের পেঁয়াজের পাইকারি ব্যবসায়ী রহমত আলী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার দোকানে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ মণ পেঁয়াজ বিক্রি হয়। আমি সেই অনুসারে কর্মচারী রেখেছি। আমার দোকানের জায়গাও এই অনুপাতে। আমি চাইলেও ২০০ মণ পেঁয়াজ এনে রাখতে পারবো না। আমি জানি, আমার দোকানে প্রতিদিন সম্ভাব্য কতজন ক্রেতা আসতে পারেন। কিন্তু হঠাৎ যদি ১০ জন ক্রেতার পেঁয়াজ পাঁচ জনে নিয়ে যায়, তাহলে বাকি পাঁচজন ক্রেতার জন্য বাড়তি পেঁয়াজ আমাকে আনতে হবে; অথবা ওই ক্রেতাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। যেহেতু আমি ব্যবসায়ী, সেহেতু আমি কোনও ক্রেতাকে ফেরাব না। তাহলে আমাকে বাকি পাঁচজন ক্রেতার জন্য বাড়তি পেঁয়াজ আনতে হয়। আর বাড়তি আনতে গেলেই সরবরাহ, মজুদ ও পরিবহন ব্যবস্থায় প্রভাব পড়ে। এভাবেই পেঁয়াজের দাম বাড়ছে।’
তিনি জানান, গতবছরের তুলনায় দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ভালো হয়েছে। ভারত থেকেও পেঁয়াজ আমদানিতে কোনও জটিলতা নেই। বাজারে কৃত্রিম সংকটের গুজবও নেই। তারপরও ক্রেতারা কেন এই হুড়োহুড়ি করছেন তা তার বোধ্যগম্য নয়।
রাজধানীর ডেমরা থানা এলাকায় কোনাপাড়া বাজারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আবদুল জলিলের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘সারাবছরের জন্য পেঁয়াজ কিনতে এসেছি। এই সময়টাই পেঁয়াজ সংগ্রহের জন্য ভালো। দামও কম থাকে। চারজনের সংসারে প্রতিমাসে ৫ কেজি পেঁয়াজের প্রয়োজন হয়।’ তাই তিনি আপাতত একসঙ্গে ২০ কেজি পেঁয়াজ কিনবেন। বিক্রেতা বলেছেন, রোজার পর দাম কমবে। কিন্তু বিক্রেতার কথায় বিশ্বাস নেই তার। তিনি কিনবেনই।
কথা হয় ইট সুরকির ব্যবসায়ী মোর্শেদ আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রোজায় দাম বাড়ে, তাই একসঙ্গে কিছুটা বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ কিনে রাখছি।’
বর্তমানে দেশে তিন ধরনের পেঁয়াজ পাওয়া যায়। প্রথমটি হচ্ছে, অরিজিনাল দেশি পেঁয়াজ; যার রং হালকা গোলাপি। এ জাতীয় পেঁয়াজের খোসা খুবই পাতলা ও হালকা। নাটোর, নওগাঁ ও জয়পুরহাটসহ দেশের উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোয় এ জাতীয় পেঁয়াজের চাষ হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ফরিদপুরের হাইব্রিড। এ জাতীয় পেঁয়াজের খোসা অনেকটাই গোলাপি রংয়ের হয়। এর খোসা দেশি পেঁয়াজের তুলনায় কিছুটা ভারী। হাইব্রিড বলে উৎপাদন বেশি হয়। এ জাতীয় পেঁয়াজ শুধু ফরিদপুর ও রাজবাড়ী জেলায় চাষ হয়। সাইজ ও দেখতে অনেকটাই অরিজিনাল দেশি পেঁয়াজের মতো বলে অনেকে এটিকেই দেশি পেঁয়াজ বলে চালিয়ে দেয়। দাম অরিজিনাল দেশি পেঁয়াজের তুলনায় কিছুটা কম। আর তৃতীয়টি হচ্ছে ভারতীয় আমদানি করা পেঁয়াজ। সাইজ বড়। কড়া গোলাপি রংয়ের এই পেঁয়াজের খোসা অপেক্ষাকৃত মোটা ও ভারী। দামও অন্য পেঁয়াজের তুলনায় কিছুটা কম।
বাংলাদেশ ট্যরিফ কমিশন সূত্র জানায়, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টন। এরমধ্যে এবার ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) দেশে উৎপাদন হয়েছে ২১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। আর ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে, চার লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ।
দেশে বর্তমানে তাহেরপুরি, বারি পেঁয়াজ-১ (তাহেরপুরি), বারি পেঁয়াজ-২ (রবি মৌসুম), বারি পেঁয়াজ-৩ (খরিপ মৌসুম), স্থানীয় জাত ও ফরিদপুরি জাতের পেঁয়াজ উৎপাদন করা হয়। ফলে বছরজুড়েই কোনও না কোনও জাতের পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। এ কারণে নির্দিষ্ট কোনও মৌসুমে এসে পেঁয়াজের সরবরাহ হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা কম বলে জানায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুন্সি শফিউল হক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ও সরবরাহ ভালো। পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে আমদানিও ইতিবাচক। কোথাও কোনও সমস্যা নেই।
পেঁয়াজ আমদানিকারক মোস্তফা খালেক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রমজানে মানুষের কিছুটা অতিরিক্ত কিনে রাখার প্রবণতার কারণে দাম হয়তো কিছুটা বেড়েছে। আশা করছি ৭/৮ রমজানের পর তা কমে যাবে। তবে এবছর পেঁয়াজের সরবরাহ ভালো। পেঁয়াজের উৎপাদনও ভালো।’