দাম্পত্য কলহে প্রাণ গেল দেড় বছরের শিশুর
রাজধানীর বনশ্রীতে দুই শিশু হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও এক মায়ের বিরুদ্ধে সন্তান হত্যার অভিযোগে উঠেছে। পুলিশ বলছে, দাম্পত্য কলহের জের ধরে মা নিজেই তাঁর সন্তানকে হত্যা করেন এবং পরে নিজে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন ও ফাহমিদা মীর দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিল নিহত নেহাল সাদিক। গত সোমবার রাতে রাজধানীর উত্তরখান এলাকার একটি বাসায় দেড় বছর বয়সী এই শিশুকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ফাহমিদা মীরকে আটক করা হয়েছে।
পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, সাজ্জাদ হোসেন ও ফাহমিদা নিজেদের পছন্দে সাড়ে চার বছর আগে বিয়ে করেন। এটি দুজনেরই দ্বিতীয় বিয়ে। বিয়ের পর থেকে তাঁরা পরস্পরকে সন্দেহ করতেন। এ নিয়ে প্রায়ই দুজনের ঝগড়া হতো। ফাহমিদাকে মাঝেমধ্যেই মারধর করতেন সাজ্জাদ। এর মধ্যেই দেড় বছর আগে নেহালের জন্ম হয়। চার দিন আগেও ছেলেকে নিজের কাছে রেখে ফাহমিদাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলেন সাজ্জাদ। কিন্তু ফাহমিদা ছেলেকে ফেলে যেতে রাজি হননি। ওই দিন রাত ১২টার দিকে তিনি বাসায় ফেরেন।
এ বিষয়ে উত্তরখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ সিরাজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ধারণা করা হচ্ছে দাম্পত্য কলহের কারণে ব্লেড অথবা ছোট চাকু দিয়ে মা তাঁর ছেলেকে হত্যা করেছেন এবং পরে নিজে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। সোমবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত সোয়া ১০টার মধ্যে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে বলে তিনি জানান।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের নাক কান গলা বিভাগের শিক্ষক দেবেশ চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আঘাত দেখে মনে হচ্ছে ফাহমিদা মীর নিজের গলায় পোঁচ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। আঘাতের গভীরতা বেশি। তবে আমরা আশা করছি, তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।’
গত সোমবার রাত সোয়া ১০টার দিকে সাজ্জাদের চিৎকারে প্রতিবেশীরা ওই বাসায় যান। এ সময় তাঁরা দেখেন, খাটের ওপর নেহালের নিথর দেহ পড়ে আছে। তার পেটে ধারালো অস্ত্রের আঘাত। পাশেই শুয়ে আছেন মা ফাহমিদা। তাঁর ঘাড়ের বাঁ পাশে কাটা দাগ। খবর পেয়ে রাতেই পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং গতকাল সকালে নেহালের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। মা ফাহমিদার আচরণ সন্দেহজনক হওয়ায় পুলিশ রাতেই তাঁকে আটক করে। প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। গতকাল সকালে তাঁকেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন।
হাসপাতালে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য জানিয়েছেন, ফাহমিদার কথাবার্তা তাঁদের কাছে অসংলগ্ন মনে হয়েছে। তিনি একেক সময় একেক কথা বলছেন। তাঁর মানসিক অবস্থা জানতে মনোরোগ চিকিৎসকের সহযোগিতা নেওয়া হতে পারে।
এদিকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, মানুষের কিছু মৌলিক প্রবৃত্তি থাকে। বিভিন্ন সামাজিক প্রক্রিয়া তাকে ঢেকে রাখে। মাঝে মাঝে মানুষ প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ হয়ে যায়, রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। তখন অপরাধ ঘটিয়ে বসে। এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সংবাদমাধ্যমে নেতিবাচক খবর প্রাধান্য দিয়ে ছাপার সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, যখন মানুষ খারাপ খবর বারবার পড়ে, তখন এর একটা প্রভাব পড়ে।
গতকাল সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে ৩০৩ নম্বর ওয়ার্ডের একটি বেঞ্চে বসে আছেন ফাহমিদা। ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ফাহমিদা প্রথম আলোকে বলেন, সাজ্জাদের সঙ্গে বিয়ের আগে তাঁর আরেকটি বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর জানতে পারেন প্রথম স্বামীর আগে অন্য এক মেয়ের সম্পর্কের কথা। সেই মেয়েকে বিয়ের জন্য ফাহমিদার কাছে অনুমতি চান তাঁর প্রথম স্বামী। ফাহমিদা অনুমতি না দিলে লুকিয়ে তিনি ওই মেয়েকে বিয়ে করেন ও উত্তরায় সংসার শুরু করেন। এ নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে ফাহমিদা তাঁর প্রথম স্বামীকে ছেড়ে বাবার বাসায় ওঠেন। ওই সংসারে তাঁর একটি কন্যা হয়। সে এখন বাবার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে।
ফাহমিদা বলেন, প্রথম স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলার সময় তাঁর পরিচয় হয় সাজ্জাদের সঙ্গে। এর কয়েক মাস আগেই সাজ্জাদ ও তাঁর প্রথম স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি হয়। সাজ্জাদের ওই সংসার টিকেছিল তিন মাস। ফাহমিদার দাবি, সাজ্জাদ ভালোবাসার অভিনয় করে তাঁকে বিয়ে করেন। কিন্তু বিয়ের পরই সব উল্টে যায়। তাঁকে সব সময় সন্দেহ ও মারধর করতে থাকেন।
ঘটনা সম্পর্কে ফাহমিদা বলেন, সোমবার সকাল ১০টায় বাসা থেকে বের হন সাজ্জাদ। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তিনি বাসায় কলবেলের আওয়াজ শোনেন। এরপর আর কিছু মনে নেই। রাতে বাসায় চিৎকার-চেঁচামেচিতে তাঁর ঘুম ভাঙলে ছেলেকে মৃত দেখতে পান। ছেলেকে কে হত্যা করেছে জানতে চাইলে ফাহমিদা বলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে অনেক ভালোবাসি। তাকে আমি কেন মারব? ওর জন্য আমি কত রাত ঘুমাইনি, কত কষ্ট সহ্য করেছি।’ তাঁর অভিযোগ, সাজ্জাদ কাউকে দিয়ে তাঁর ছেলেকে হত্যা করেছেন।
এদিকে গতকাল বিকেলে উত্তরখান থানায় সাজ্জাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিনের মতো সোমবার রাতে বাসায় ফিরে বাইরে থেকে দরজা আটকানো দেখতে পাই। দরজা খুলে বাসায় ঢুকে মা-ছেলেকে বিছানায় দেখি। ছেলের বুক থেকে নিচ পর্যন্ত কাঁথা দিয়ে ঢাকা ছিল। কাঁথা তুলে পেটে কাটা দাগ দেখতে পাই। পরে চিৎকার শুরু করি।’
সাজ্জাদের অভিযোগ, তাঁর স্ত্রী ছেলেকে হত্যা করেছেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘ক্ষোভ থাকলে আমাকে মারত। আমার বাচ্চাটা কী দোষ করেছিল।’
ফাহমিদার সঙ্গে একাধিক পুরুষের অনৈতিক সম্পর্ক ছিল দাবি করে সাজ্জাদ বলেন, এ নিয়ে প্রায়ই তাঁদের ঝগড়া হতো।
মাস্টারপাড়া সোসাইটির এ/পি ৮৫৯ নম্বর বাসার চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন সাজ্জাদ-ফাহমিদা দম্পতি। গতকাল বিকেলে ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায়, সদর দরজা তালাবদ্ধ। পাশের ফ্ল্যাটের নাজনীন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, নিয়মিত তাঁদের ঝগড়া হতো। সাজ্জাদ স্ত্রীকে মারধরও করতেন। তিন দিন আগে সাজ্জাদ ফাহমিদাকে বাসা থেকে বের করে দেন। সাজ্জাদ স্ত্রীকে সন্দেহ করতেন বলে তিনি জানান।
নাজনীন আক্তার বলেন, সোমবার সন্ধ্যায় ফাহমিদা তাঁকে বাইরে থেকে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিতে বলেন। সে অনুযায়ী তিনি ছিটকিনি লাগান। পরে রাত সোয়া ১০টার দিকে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে পারেন।
সাজ্জাদের বাড়ি ভোলার দৌলতখানের গুপ্তের বাজার। তিনি ঢাকার একটি বিপণিবিতানে বিক্রয়কর্মীর কাজ করেন। আর ফাহমিদার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে। ফাহমিদা ইডেন কলেজে সমাজকল্যাণ বিভাগে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু স্নাতক শেষ করার আগেই তিনি পড়ালেখা ছেড়ে দেন।