বাড়ছে অপহরণ আতংক

opohoron

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে অপহরণ ও অপহরণের পর খুন অথবা মুক্তিপণ দাবির ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিষয়টি সাধারণ মানুষের মধ্যে আতংক সৃষ্টি করেছে। ২০১৫ সালে সারা দেশে যেখানে ৮০২টি অপহরণ মামলা হয়েছে, সেখানে এ বছরের জানুয়ারিতেই হয়েছে প্রায় ১৫০টি মামলা। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে অপহরণের পর বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। মুক্তিপণ দাবির ঘটনাও ঘটছে। আবার বেশ কিছু ঘটনায় র‌্যাব বা পুলিশ পরিচয়ে অপহরণের অভিযোগও আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধার করতে পারছে না।
অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করতে না পারলে এ ধরনের অপরাধ বাড়তেই থাকবে বলে জানান অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলেও মত দেন তারা। অন্যদিকে, অপহরণ বা নিখোঁজের ঘটনা ঘটলে দ্রুত পুলিশকে জানানোর পরামর্শ দেন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এছাড়া নিজেরা মুক্তিপণ দিয়ে ভিকটিমকে উদ্ধারের চেষ্টা করা উচিত নয় বলেও জানান তারা।
পুলিশ সদর দফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৩ সালে সারা দেশে অপহরণ মামলা ছিল ৮৭৯টি, ২০১৪ সালে ছিল ৯২০টি। আর ২০১৫ ছিল ৮০২টি। অন্যদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারিতেই ১৫০টি মামলা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্রে জানা গেছে।

সোমবার বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে এক সংবাদ সম্মেলনে রামপুরা থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন তপুকে অপহরণের অভিযোগ করেন তার মা সালেহা বেগম। তিনি বলেন, ২৬ জানুয়ারি ডিবি পুলিশ পরিচয়ে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে অপহরণ করা হয় তপুকে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। থানা পুলিশ বা ডিবি তাকে আটকের বিষয়টি স্বীকার করেনি। তিনি সন্তানকে ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
তবে পুলিশ বলছে, তপুর বিরুদ্ধে সিআইডির এএসপি ফজলুর রহমান হত্যা মামলাসহ এক ডজনের বেশি মামলা আছে। তাকে খুঁজছে পুলিশ।
শুক্রবার কেরানীগঞ্জের রুহিতপুর ইউনিয়নের মুগারচর এলাকা থেকে স্কুলছাত্র আবদুল্লাহকে (১১) অপহরণ করা হয়। শনিবার তার পরিবারের কাছে সাড়ে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে তিনটি বিকাশ নম্বর দেয়া হয়। অপহরণকারীদের কথামতো এক লাখ টাকা দিয়েও আবদুল্লাহকে ফেরত পায়নি তার পরিবার। এ নিয়ে এলাকাবাসী মানববন্ধন-বিক্ষোভও করেছে।

৩০ জানুয়ারি সাভারে শিশু শিহাব হোসেনকে (১০) অপহরণ করে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। রাতে শিশুটিকে মানিকগঞ্জের সিংগাইরের জামিরতা গ্রাম থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।
২৭ জানুয়ারি ধামরাইয়ের শাকিল ও ইমরান নামে দু’শিশুকে অপহরণের পর এক লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়। না পেয়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে গলা কেটে হত্যা করে অপহরণকারীরা। ২৯ জানুয়ারি মির্জাপুর উপজেলার কামারপাড়া ময়ূরভাঙ্গা এলাকার লেবু বাগান থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। দু’শিশুর বাড়ি চরচৌহাট গ্রামে। সাভার সার্কেলের সিনিয়র এএসপি মোহাম্মদ রাসেল শেখ যুগান্তরকে বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিনজনকে আটক করা হয়েছে। ইমরানের চাচা তারা মিয়া, তারা মিয়ার ছেলে মিল্টন ও প্রতিবেশী রাসেল এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত।

২৮ জানুয়ারি কুষ্টিয়া শহরের মঙ্গলবাড়িয়া বাজারসংলগ্ন আশরাফুল উলুম কওমি মাদ্রাসা থেকে ছাত্র আবুজর গিফারীকে (২২) র‌্যাব পরিচয়ে সাদা পোশাকে তুলে নেয়া হয়। ৫ দিনেও তার হদিস পায়নি আত্মীয়রা। ছেলের সন্ধান না পেয়ে তার বাবা চুয়াডাঙ্গা সদর থানা জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আমির হোসেন রোববার চুয়াডাঙ্গা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, র‌্যাব পরিচয়ে এক দল দুর্বৃত্ত তার ছেলেকে অপহরণের পর সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান পাননি।

২৫ জানুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালের পাঁচপাড়া গ্রামের স্কুলছাত্রী সুমাইয়াকে (১৩) অপহরণ করা হয়। এ ঘটনায় কেউ মুক্তিপণ দাবি করেনি। তার সন্ধান চান বাবা-মাসহ স্বজনরা। পারিবারিক সূত্র জানায়, সুমাইয়া এ বছর সপ্তম শ্রেণীতে উঠেছে। ২৫ জানুয়ারি সকালে কোচিংয়ের উদ্দেশে বের হয়। এরপর আর ফিরে আসেনি। পথিমধ্যে তাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পরিবারের সদস্যদের।
২৩ জানুয়ারি আশুলিয়ার জিরাবো বাজার এলাকা থেকে আরফাউল (৭) ও রেমন বাবু (৬) নামে দুই ছাত্রকে অপহরণ করা হয়। তারা জিরাবো মডেল একাডেমির প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। পরদিন আরফাউলের বাবা আনিসুল হক ও রেমনের ফুফু থানায় পৃথক ডায়েরি করেছেন। কিন্তু ৯ দিনেও শিশু দুটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আশুলিয়া থানার ওসি মহসিনুল কাদির জানান, শিশু দুটিকে উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।

১১ জানুয়ারি যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগের পোলা মশার কয়েল ফ্যাক্টরির মালিক জাহাঙ্গীর হোসেনকে (২৬) অপহরণ করে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। তার সাবেক প্রেমিকা আফসানার পরিকল্পনায় তার স্বামীসহ কয়েক সহযোগী জাহাঙ্গীরকে অপহরণ করে বলে অভিযোগ। ১৩ জানুয়ারি দাউদকান্দি থেকে জাহাঙ্গীরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে পুলিশ আফসানা ও অপর সহযোগীদের গ্রেফতার করে।

২১ জানুয়ারি রাজধানীর রমনা থেকে সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ীকে সাত লাখ টাকাসহ তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। তার সঙ্গে থাকা টাকা ছিনিয়ে মুখে স্কচটেপ ও হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ২৪ জানুয়ারি ডেমরা এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। টাকা ছিনিয়ে নেয়ার জন্য সন্ত্রাসী গ্রুপ তাকে অপহরণ করেছে। এ বিষয়ে তার স্ত্রী জ্যোতি ইসলাম শনিবার রমনা থানায় জিডি করেন।

২৩ জানুয়ারি ফিরোজপুর সদরের বিএনপি নেতা নজরুল ইসলামকে (৪৮) অপহরণ করা হয়। ঘটনার ৭ দিন পর এলাকার একটি ধান ক্ষেত থেকে তার গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।
২২ জানুয়ারি রাজশাহীতে এক্সিম ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আক্তারুজ্জামান কচি নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা অপহরণের শিকার হন। তার পরিবারের সদস্যরা সংবাদ সম্মেলন ডেকে তাকে উদ্ধারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। কিন্তু কচিকে ১০ দিনেও উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
গত বছরের ২৯ নভেম্বর খিলগাঁও দক্ষিণ বনশ্রী এলাকার আবু বক্কর (রা.) মসজিদের প্রধান খতিব মাওলানা আতাউল্লাহর ছেলে মুফতি হুজাইফাকে (২০) অপহরণ করা হয়। অপহৃত হুজাইফার বাবা মাওলানা আতাউল্লাহ বলেন, দক্ষিণ বনশ্রীতে মসজিদ ও মাদ্রাসার উন্নয়নকে কেন্দ্র করে একটি পক্ষের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব চলছে। এর জেরে তার ছেলে হুজাইফাকে অপহরণ করা হয়েছে।
৪ নভেম্বর শান্তিবাগের বাসার তালা ভেঙে এক শিশু ও গৃহকর্মীকে অপহরণের ৯ ঘণ্টা পর তাদের উদ্ধার করে পুলিশ। ৪ নভেম্বর শান্তিবাগের বাসা থেকে সাড়ে তিন বছরের শিশু ইলমা ও গৃহকর্মী ৮ বছর বয়সী নার্গিসকে চকলেট কিনে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অপহরণ করে অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তি। ঘটনার সময় গৃহকর্তা আনোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী অঙ্কিতা আহমেদ রুবি কর্মস্থলে ছিলেন।

১ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর থেকে সাড়ে ৪ বছরের শিশু রাহিমুল ইসলাম রনককে অপহরণ করা হয়। সে মিঠাপুকুর আদর্শপাড়ার ব্যবসায়ী মোছাদ্দেক হোসেন রাঙার ছেলে। ঘটনার ২ মাস পর শুক্রবার উপজেলার খোড়াগাছ তেপানি পাথার এলাকা থেকে রনকের বস্তাবন্দি মাটিচাপা দেয়া লাশ উদ্ধার করা হয়।
বিশিষ্ট অপরাধ বিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, অপহরণের ঘটনা বাড়ায় সাধারণ মানুষের মনে আতংক তৈরি হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপহরণের পর মুক্তিপণ নেয়া হয় মাদকের টাকা জোগাড়ের জন্য। এক্ষেত্রে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। অপহরণকারী চক্রের সদস্যদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করতে না পারলে এ অপরাধ আরও বাড়তেই থাকবে।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান যুগান্তরকে বলেন- নারী, শিশু বা যে কোনো ব্যক্তি অপহরণের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই র‌্যাব সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে। প্রায় প্রতিদিনই অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি ও কয়েকটি হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত আসামিদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার বিষয়ে র‌্যাব তৎপরতা চালাচ্ছে। অপহরণের ঘটনা ঘটলেই দ্রুত র‌্যাবকে জানানোর অনুরোধ করে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, দ্রুত তথ্য পেলে ভিকটিম উদ্ধার করা সহজ হয়। দেরি হলে অনেক ক্ষেত্রে ভিকটিমের প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব হয় না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (ক্রাইম) হেলাল উদ্দিন বদরী বলেন, তথ্য-উপাত্ত দেখে এ বিষয়ে কথা বলতে হবে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মো. মারুফ হোসেন সরদার বলেন, অপহরণ বা নিখোঁজের অভিযোগ পেলে দ্রুততার সঙ্গে তদন্ত করে পুলিশ। দুর্বৃত্তরা নানা রকম কৌশলের আশ্রয় নেয়ায় অনেক সময় শনাক্তে একটু সময় লাগে। তিনি বলেন, কোনো অপহরণ বা নিখোঁজের ঘটনা ঘটলে দ্রুত পুলিশকে জানান। নিজেরা মুক্তিপণ দিয়ে ভিকটিমকে উদ্ধারের চেষ্টা করা উচিত নয়।