মোহাম্মদপুরে নিউ কলোনি উচ্ছেদ ‘আমাদের একটু সময় দিল না ওরা’
বছরের পর বছর থাকলেও এখন তারা অবাঞ্ছিত নিউ কলোনিতেঘরের ভেতর বাসিন্দারা থাকতেই ভেঙে ফেলা হচ্ছে ভবন। বাধা দিতে গেলেই হাত তোলা হচ্ছে গায়ে। বছরের পর বছর যারা ছিলেন, মুহূর্তে তারা হয়ে গেলেন অবাঞ্ছিত। কান্না, আহাজারিতে এভাবেই আজ দিনভর উচ্ছেদ তাণ্ডব চললো রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নিউ কলোনিতে। কলোনির বাসিন্দাদের অভিযোগ, আদালতের স্টে অর্ডারের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে এ উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সাংসদ জাহাঙ্গীর কবির নানক ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি মাসুদ বারীর ছত্রছায়ায়।
বাসিন্দারা জানান, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ৩০ বছর ভাড়া দিয়ে এলে নিউ কলোনির এই ফ্ল্যাটগুলো বাসিন্দাদের নামে দিয়ে দেওয়া হবে। সে অনুযায়ী বাসিন্দারা ভাড়াও পরিশোধ করে এসেছিলেন। এখন বলা হচ্ছে, এখানে সরকারি সুউচ্চ ভবন হবে এবং এখানে নিন্ম ও মধ্যবিত্তদের ফ্ল্যাট কিনে নিতে হবে।
নিউ কলোনির বাসিন্দারা আরও জানিয়েছেন, সর্বোচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকার পরও শুধু ক্ষমতার জোরে এমন অমানবিক কাজ করেছেন স্থানীয় সাংসদ ও কমিশনার। সরেজমিনে দেখা গেল স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ডানহাত পরিচিত বাদশা নামের একজন পুরো কাজের তদারকি করছেন। উচ্ছেদের সময় তিনিই গলা উঁচিয়ে বলেছেন, ‘এখনও কেন সব ভাঙা হচ্ছে না! সব ভেঙে ফেল, ঘর থেকে বাইর কইরা দে সবাইরে!’
দুপুর সাড়ে বারোটায় লালমাটিয়ার মাঠের পাশে মোহাম্মদপুরের নিউ কলোনি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ভবনগুলো থেকে বিভিন্ন মালামাল জড়ো করা হচ্ছে পাশের মাঠে। কেউ চোখের জল ফেলতে ফেলতে নিজেদের মালামাল তুলে দিচ্ছেন ভ্যান ও ট্রাকে।
সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতেই একযোগে ক্ষোভ ও হতাশা ঝাড়তে শুরু করেন বাসিন্দারা। ‘আমাদের জায়গা নাই, বাড়ি নাই, ঘর নাই। আমরা কোথায় যাবো!’ বিলাপ করছিলেন এমন অনেকে যারা এখানে বাস করে আসছিলেন যুগের পর যুগ। এমন একজন মোশাররফ হোসেন। জানালেন, ‘আমরা ৬২ বছর ধরে এখানে আছি। এখানে কমমূল্যে বাসা পাওয়ার অধিকার আমরা রাখি। আমাদের যাদের জন্ম এখানে, তাদেরকে ফ্ল্যাট থেকে বঞ্চিত করে দেওয়া হয়েছে পলিটিক্যাল লিডার আর মাস্তানদের।’
আজ রাত কোথায় কাটবে জানেন না তারাতিনি আরও জানান, ‘ওয়ার্ড কমিশনার মিজান সাহেবের সঙ্গে ওরা গোপনে বৈঠক করতো। তাদের নামে ফ্ল্যাট বরাদ্দ হয়েছে। অথচ আমাদের এই ১১৪টা পরিবারের নামে কিছু হয়নি।’
বাসিন্দারা আরও জানান, “সরকার হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটা ভেঙে অন্য কোথাও একটা ব্যবস্থা করবে। কিন্তু সেটারতো অনেক দাম হবে। ওই সামর্থ্য আমাদের নেই। এ কারণে গতবছর উচ্ছেদ শুরুর পরিকল্পনার সময় থেকেই হাইকোর্টে মামলা করেছি। যেটার শুনানি হয়েছে গতকাল। কোর্ট তাদের কাছে ‘কেন উচ্ছেদ করা হচ্ছে’ মর্মে জানতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকার পক্ষ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কোর্টে দাখিল করতে পারেনি। পরে কোর্ট ২১ জানুয়ারি শুনানির তারিখ নির্ধারণ করে। ততদিন পর্যন্ত হাইকোর্ট এসব ভবন ভাঙার বিষয়ে স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন। সেই স্টে অর্ডারও ওরা মানেনি। ভবনতো ভাঙছেই, আদালত অবমাননাও করেছে।”
পাশের একজন বলেন, ‘এই শীতের দিনে বৃদ্ধ বাবা মা, ছেলে-মেয়ে নিয়ে কোথায় উঠবো? আমাদের একটু সময় দিলো না ওরা। ঘরের ভেতরে মানুষ থাকা অবস্থাতেই সকাল দশটায় এসে বিল্ডিং ভাঙা শুরু করেছে। পুলিশ নিয়ে এসেছে।’
পাশে থাকা আরেক নারী একনাগাড়ে কেঁদেই চলেছেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘ঘরের ভেতর থেকে কোনও জিনিস নামানো হয়নি। আমাদের নারীদের গায়ে হাতও তোলা হয়েছে। থানায় গিয়েছিলাম। কেস নিলো না থানা। আমরা ৮ লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাটগুলো কিনেছি। আমাদেরকে একটা দিন সময় দিতে পারতো। পুলিশ এখানে দাঁড়িয়ে। অথচ সব করছে স্থানীয় মাস্তানরা, নানক সাহেবের লোকেরা।’
‘সরকারি কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে’ এমন অভিযোগে গতকাল সোমবার রাতে কলোনির ১০-১২ জন পুরুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানালেন নিউ কলোনির বাসিন্দারা। শিরিন আসহান নামের এক নারী বলেন, ‘এ এলাকায় এখন কোনও তরুণ নেই, যারা আছে তারা বৃদ্ধ। মাস্তানদের বিরুদ্ধে কেউ যেন কথা বলতে না পরে এ জন্যই তরুণদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে যখন তারা আমাদের মারধোর করেছে, থানা মামলা নেয়নি। আমরা কি এদেশের জনগণ না?’
কোটি টাকা খেয়ে হাউজিংয়ের কিছু মানুষ আমাদের ক্ষতি করছে’ এমনও অভিযোগ তার।
কলোনির বাসিন্দা জারিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ বারী, বদি, সোহাগ, আকবর, উজ্জল, জামাল এদের চক্রান্তের শিকার আমরা। ১০ বছর আগে ওরা একেকজন এই এলাকায় এসেছে। এসে সংঘবদ্ধ গ্রুপ হয়ে ডেভেলপারকে জায়গাটা দিয়েছে যেন ওরা ব্যবসা করতে পারে। এজন্য আমাদের এ অবস্থা। ওরা পরিচয় দেয়, ওরা প্রধানমন্ত্রীর কর্মী, আওয়ামী লীগের কর্মী। নানক সাহেবের সঙ্গে ওরা গোপন মিটিং করে। নানক সাহেব প্রথমে আমাদের সমর্থন করলেও পরে তার কাছ থেকে হতাশ হয়ে ফিরে আসি আমরা।’বাসিন্দারা বাসা না ছাড়তেই শুরু হলো ভাঙা
পাশ থেকে আরেক নারী বলেন, ‘আমরা কি আওয়ামী লীগ করি না? আমরা কি ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনিনি? আর ওরা আজ আমাদের গায়ে হাত তুললো, বাড়িঘর লুট করলো, ভাঙচুর করলো।’
তিনি বলেন, ‘কাল রাতে আমরা থানায় গিয়েছিলাম হামলা হতে পারে জেনে। পৌনে নয়টা থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত বসেছিলাম। কিন্তু মোহাম্মদপুর থানা আমাদের কথা শোনেনি। ওই মুহূর্তে ওখানে বসেছিলেন মাসুদ বারী। উনি হাসছিলেন।’
তড়িঘড়ি বের হওয়ায় মালামাল রাখতে হয় খোলা মাঠেইএ বিষয়ে জানতে চাইলে ৩২ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুদ বারী বলেন, ‘যারা অভিযোগ করেছে তারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এখানে বহুতল ভবন হবে আর সেটা করতে গেলে পুরাতন এসব ভবন ভাঙতেই হবে। আর আমার সরকার যেখানে উন্নয়নমূলক কাজ করবে, আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে সেখানে আমি বাধা দিতে পারি না।’
জানা গেল এখানকার ৭টি ভবনে দীর্ঘদিন ধরে মোট ১১৪টি পরিবার বসবাস করে আসছিল। এদের সবাই মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও চিকিৎসক পরিবারের।
এ বিষয়ে জানতে স্থানীয় সাংসদ জাহাঙ্গীর কবির নানককে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।