স্কুলছাত্রের গলিত মরদেহ উদ্ধার

চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী থানার সাগরিকায় জহুর আহম চৌধুরী স্টেডিয়ামের পেছনে একটি খাল থেকে ফিরোজ আলম বাঁধন (১৩) নামে এক স্কুলছাত্রের গলিত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।  বাঁধনকে তার চাচাতো ভাই হৃদয় মল্লিক (২৩) নির্মমভাবে খুন করে লাশ বস্তায় ভরে খালে ফেলে দেয়।  এরপর নিজের পরিচয় গোপন করে হৃদয় বাঁধনকে অপহরণের নাটক সাজায়।

পাঁচদিন নিখোঁজ থাকার পর রোববার (৮ মে) দুপুরে চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা ‍পুলিশ ও পাহাড়তলী থানা পুলিশ হৃদয়ের কাছ থেকে বাঁধনের বিষয়ে তথ্য আদায় করতে সক্ষম হয়।  এরপর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সাগরিকা স্টেডিয়ামের পেছনে জেলেপাড়ার পাশে জোড়াখাল থেকে বাঁধনের বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।  পুলিশ হৃদয়কে আটক করেছে।

বাঁধন অপহরণের রহস্য উদঘাটনের দায়িত্বে থাকা নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এস আই) সন্তোষ কুমার চাকমা বাংলানিউজকে বলেন, ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে বাঁধনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে হৃদয় আমাদের ‍জানিয়েছে।  তারপর একটি বস্তায় ভরে মরদেহ খালে ফেলে দেয় হৃদয়।  বস্তায় কিছু আলুও দেয়া হয় যাতে মানুষ সন্দেহ না করে।  নির্মম এই খুনের পর হৃদয় আবার নিজের পরিচয় গোপন করে বাঁধনকে অপহরণ করা হয়েছে জানিয়ে তার বাবার কাছে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।  কিন্তু আমাদের কৌশলের কাছে হৃদয় ধরা খেয়ে যায়।  এক পর্যায়ে সে সত্য স্বীকার করে নিতে সক্ষম হয়।

বাঁধন পাহাড়তলী থানার ফইল্যাতলী এলাকার রঙমিস্ত্রি রমজান আলী মল্লিক এবং পোশাক কারখানার কর্মী বেগম আক্তারের একমাত্র ছেলে।  বাঁধন স্থানীয় পিএইচ আমিন একাডেমির অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র।

পাহাড়তলী থানার ওসি রণজিৎ কুমার বড়ুয়া জানান, হৃদয়ের বাবা মফিজুল আলম মল্লিক।  তার মাও পোশাক কারখানার কর্মী।  মফিজুল ও রমজান দুই ভাই ফইল্যাতলীতে একই বাসায় থাকেন।

গত ৩ মে হৃদয় তার চাচাতো ভাই বাঁধনকে খুনের পরিকল্পনা করে।  সে বাজার থেকে দশটি ঘুমের ট্যাবলেট কিনে আনে।  ৪ মে সকালে বাঁধন ও হৃদয়ের বাবা-মা কর্মস্থলে চলে যান।  বাসায় ছিল শুধুমাত্র হৃদয় ও বাঁধন।

ওসি বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে কোন এক সময়ে প্রথমে টাইগার এনার্জি ড্রিংকের ভেতরে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে সেগুলো বাঁধনকে খাইয়ে অজ্ঞান করে হৃদয়।  তারপর গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।  সন্ধ্যায় বাঁধনের বাবা তার মোবাইলে ফোন করেন।  এসময় হৃদয় ফোন রিসিভ করে বলে, তোমার ছেলেকে অপহরণ করা হয়েছে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দিলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে।  না হলে হত্যা করা হবে।

ওসি জানান, ঘটনা শুনে বাঁধনের বাবা দ্রুত বাসায় আসেন।  এসে দেখেন বাসা খালি।  কিছুক্ষণ পর হৃদয় বাসায় ফিরলে তাকে বাঁধনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সে কিছুই জানেনা বলে জানায়।  তিনি অপহরণের বিষয়টি জানালে হৃদয় থানায় গিয়ে জিডি করার পরামর্শ দেন।

৪ মে রাতে বাঁধনের বাবা ও হৃদয় নগরীর হালিশহর থানায় গিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) দায়ের করেন।  কিন্তু ঘটনাস্থল পাহাড়তলী থানা হওয়ায় হালিশহর থানা থেকে জিডিটি সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠানো হয়।  ওই জিডির ভিত্তিতে তদন্তে নামে পাহাড়তলী থানা পুলিশ।

ওসি বলেন, আমরা বিভিন্নভাবে বাঁধনের খোঁজখবর নিতে শুরু করি।  আমাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে হৃদয়ও ছিল।  আবার সে আমাদের অন্ধকারে রেখে বারবার বাঁধনের সন্ধান দেয়ার কথা বলে দুই লক্ষ টাকা দাবি করছিল।

কিন্তু তিনদিনেও কোন হদিস না পাওয়ায় ৭ মে পাহাড়তলী থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন বাঁধনের বাবা রমজান।  সিএমপি কমিশনারের নির্দেশে মামলা তদন্তের দায়িত্ব পান নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এস আই) সন্তোষ কুমার চাকমা।

সন্তোষ বলেন, শুরু থেকেই হৃদয়কে আমাদের সন্দেহ হচ্ছিল।  এক পর্যায়ে বাঁধনের বাবাকে যে মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করে মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছিল সেটি এবং হৃদয়ের মোবাইল নম্বর আমরা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে অনুসরণ করা শুরু করি।  আজ (রোববার) দুপুরে হৃদয়কে কঠোরভাবে জেরা শুরু করা হয়।  জেরার এক পর্যায়ে হৃদয় স্বীকার করে বাঁধনকে হত্যা করে সে মরদেহ খালে ফেলে দিয়েছে।  হৃদয়ের কথামতো দ্রুত ওই খালে এসে মরদেহ পাওয়া যায়।

হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে হৃদয়ের স্বীকারোক্তির কথা জানতে চাইলে পাহাড়তলী থানার ওসি রণজিৎ কুমার বড়ুয়া বলেন, ৪ মে খুনের পর সন্ধ্যার দিকে বাঁধনের মরদেহ লুঙ্গি দিয়ে মুড়িয়ে বস্তায় ভরে ফেলে দেয়া হয় জোড়াখালে।  বস্তার ভেতরে আলুও দেয়া হয়।  বস্তা যখন ফেলছিল তখন পথচারীরা সেটি কিসের বস্তা জিজ্ঞেস করেছিল।  এসময় হৃদয় বলেছিল, আলু পঁচে গেছে।  সেজন্য ফেলে দেয়া হচ্ছে।

রোববার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বাঁধনের মরদেহ খাল থেকে পাড়ে তোলেন পাহাড়তলী থানা পুলিশ।  গলিত মরদেহটি ফুল-পঁচে গেছে।  মরদেহে পোকার আক্রমণ দেখা গেছে।  বস্তার ভেতরে একটি সাদা হ্যান্ডগ্লাভসও পাওয়া গেছে।

এসময় বাঁধনের বাবা রমজান আলী মল্লিক মরদেহটি তার ছেলের বলে শনাক্ত করেন।

হৃদয়কে আটক করে নগর গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন এস আই সন্তোষ কুমার চাকমা।

কেন এই হত্যাকাণ্ড ?
কি কারণে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত করে কিছু জানাতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশ।

তবে নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারি কমিশনার জাহাঙ্গির আলম জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তারা তিন ধরনের তথ্য পেয়েছেন।  প্রথমটি হচ্ছে, যৌথ পরিবারে বিরোধ।  দ্বিতীয়টি হচ্ছে নেশাগ্রস্ত হৃদয় তার প্রেমিকার জন্য টাকা সংগ্রহ করতে বাঁধনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা।  তৃতীয়টি হচ্ছে, হৃদয়ের মোবাইলে তার প্রেমিকার কিছু নগ্ন ছবি ছিল।  সেই ছবিগুলো বাঁধন দেখে ফেলেছিল।  সে কাউকে বলে দেবে এই ভয়ে তাকে খুন করা হয়।

রমজান আলী মল্লিকদের পৈতৃক বাড়ি দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জে।  কাজের সূত্রে তারা চট্টগ্রাম শহরে থাকতেন বলে জানিয়েছেন ওসি।