ছাই বুকে নিয়ে কাঁদছে আলাউদ্দিন খাঁ জাদুঘর

3_3793

সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত বেহালা, ভারত সরকারের দেয়া মূল্যবান বাদ্যযন্ত্র, সৌদি সরকারের দেয়া জায়নামাজ কিংবা এমনি নানা মূল্যবান উপকরণ কোনোটি ছাই, কোনোটি টুকরো টুকরো। পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তেমনি পড়ে আছে ভাঙা, দুমড়ানো-মুচড়ানো কিংবা পুড়ে যাওয়া আসবাব। ক্লাস করতে এসে বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকরা তা দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। ক্লাস না করেই ফিরলেন ক্ষোভ আর প্রতিবাদ জানিয়ে। আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতি জাদুঘর ও সঙ্গীতাঙ্গনের বৃহস্পতিবারের চিত্র ছিল এটি। প্রায় একই ছবি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পাঠাগার ও তিতাস সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদেরও। এ তিন প্রতিষ্ঠানই মঙ্গলবারের তাণ্ডবের ঘটনায় বুধবার রাতে মামলা করেছে। এ নিয়ে ওই ঘটনায় মামলার সংখ্যা ঠেকল ৯-এ। সাংস্কৃতিক সংগঠন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মাদ্রাসাছাত্রদের তাণ্ডবে সংস্কৃতি কর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। এর প্রতিবাদে ও দোষীদের গ্রেফতার দাবিতে বুধবার রাতে প্রতিবাদ সভা করেছেন তারা। বৃহস্পতিবার করেছেন বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ।

বুধবার রাতে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার এমএ মাসুদ সেদিনের ঘটনায় আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কাজ করছে আগের কমিটিও। তবে ৭ দিন সময় চেয়েছে কমিটি। সোমবার রাতে মাদ্রাসাছাত্রদের সঙ্গে জেলা পরিষদ মার্কেটের ব্যবসায়ী ও পুলিশ-ছাত্রলীগ- যুবলীগের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় আহত জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার ছাত্র হাফেজ মাসুদুর রহমান মারা যান হাসপাতালে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ মাদ্রাসাছাত্র ও তাদের সমর্থকরা মঙ্গলবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে দিনভর নারকীয় তাণ্ডব চালায়।

বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রেলস্টেশনে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। কাঁদছে আলাউদ্দিন খাঁ জাদুঘর : বৃহস্পতিবার সেখানে গেলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মাদ্রাসাছাত্র ও সঙ্গে আসা অন্যরা প্রথমে বাইরের গেটে হামলা করে। বাইরের দিকে দরজা-জানালা ভাংচুর করে। তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে সবকিছু তছনছ করে আগুন লাগিয়ে দেয়। তখন ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও আগুন নেভাতে আসেনি। পুলিশ ও প্রশাসনের লোকদের জানানো হলে তারাও আসেননি। এমনকি সঙ্গীতাঙ্গনের বাইরে থাকা বাদাম বিক্রেতার ভ্যানটিও তাদের আগুন থেকে রেহাই পায়নি। বৃহস্পতিবার সেখানে ভিড় করেন শহরের বিপুলসংখ্যক সংস্কৃতিকর্মী। বৃহস্পতিবার থেকে এখানে ক্লাস শুরু হয়। সে কারণে আসেন প্রশিক্ষণার্থীরাও। সঙ্গীত, নৃত্য, ছবি আঁকার ক্লাসের শিক্ষার্থী ও অভিভাবক তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানের এ চেহারা দেখে চোখের পানি ফেলে ফিরে যান। ঘটনার পর কেঁদেকেটে অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনকে সন্তানের মতো আগলে রাখা সম্পাদক কবি আবদুল মান্নান সরকার। তিনি বলেন, হামলাকারীরা মিউজিয়ামে রাখা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত সরোদ, বেহালা, সন্তুর, এস াজ, সৌদি আরবের বাদশাহর দেয়া জায়নামাজ, ভারতের মাইহার রাজ্যের রাজার দেয়া গালিচাসহ সব বাদ্যযন্ত্র ও আসবাবপত্র পুড়িয়ে দেয়।

সুর সম্রাটের আত্মীয় ও শিষ্যদের কাছে নিজ হাতে লেখা অগণিত চিঠি, ছবি ও বড় পোর্ট্রেটও পুড়িয়ে দেয় তারা। অফিস রুম, ক্লাসরুম, মিউজিয়ামসহ প্রতিটি কক্ষেই আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন দীর্ঘদিনের নৈশপ্রহরী ও পিয়ন প্রবীন্দ্র চন্দ্র সরকার। তিনি বলেন, অফিস কক্ষে বসে টিভি দেখছিলাম। হামলা হলে প্রাণ রক্ষার্থে দৌড় দেই। পরে এসে দেখি, ওস্তাদের ব্যবহৃত পুরনো দুটি সেতার, দুটি সরোদসহ সঙ্গীতাঙ্গনের একতারা, দোতারা, সারিন্দা, বেহালা, ২২টি হারমোনিয়াম, ১৪ জোড়া তবলা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অনেক দুর্লভ ছবি, আসবাবপত্র, সরোদ মঞ্চের মালামাল, অফিস কক্ষে রাখা আলাউদ্দিন খাঁ’র বাড়ির দলিলপত্র, হিসাব খাতা, গানের বই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সরোদ মঞ্চের সামনে রাখা তিনশ’ প্লাস্টিকের চেয়ার ও ২২টি বৈদ্যুতিক পাখা ভেঙে ফেলা হয়েছে। সঙ্গীতাঙ্গনের যুগ্ম সম্পাদক মনজুরুল আলম বলেন, সুর সম্রাটের স্মৃতিবিজড়িত জিনিসপত্রের ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। এখন দালানটি ছাড়া আর কিছুই বাকি রইল না। সঙ্গীত প্রশিক্ষক পাপিয়া চৌধুরী ও তবলা প্রশিক্ষক আবেদুল হোসেন বাবলু বলেন, বুক ফেটে কান্না আসছে। আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারব কি না জানি না। কখন আবার ক্লাস করাব তা জানি না। তিতাস সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের সম্পাদক বাছির দুলাল বলেন, আমরা দেশে-বিদেশে গিয়ে বুক ফুলিয়ে বলতাম আমরা ‘সুর সম্রাট’র দেশের লোক। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গর্ব নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনের সভাপতি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পক্ষের লোকেরা এমন নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রতিটি ঘটনারই মামলা হবে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে।

বিশ্ববরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ, মাইহার ঘরানার রূপকার সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৯৫৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কুমারশীল মোড়ে ৫৬ শতক জায়গা শিবপুরের জমিদারের কাছ থেকে কেনেন। তিনি কলকাতা, মাইহারসহ বিভিন্ন স্থান থেকে এসে কিছুদিন এখানে থাকেনও। মাঝেমধ্যে থাকতেন হালদারপাড়ার ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর বাড়িতেও। পরে আয়েত আলী খাঁ এ বাড়িটিকে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীত কলেজ হিসেবে গড়ে তুলেন। আলাউদ্দিন খাঁ নিজেও এখানে ছাত্রদের তালিম দিতেন। স্বাধীনতার পর থমকে যায় কলেজটি। ১৯৭৫ সালে চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন যুক্তরাষ্ট্রে গেলে আলাউদ্দিন খাঁর ছেলে ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ জয়নুলকে অনুরোধ করেন বাড়িটিকে সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সক্রিয় করতে। জয়নুল আবেদীন দেশে ফিরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে স্থানীয় সুধী সমাজের সঙ্গে সভা করে সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।

২০১১ সালে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের নামে সামনের দিকের একটি কক্ষে আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান। সেখানেই রাখা হয় খাঁ সাহেবের দুর্লভ সব জিনিসপত্র। বিক্ষোভ : বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে জেলার সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মী ও মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। শহর ঘুরে প্রেস ক্লাব চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন তারা। জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক আবদুন নূরের সভাপতিত্বে তিতাস আবৃত্তি সংগঠনের পরিচালক মো. মনির হোসেন সমাবেশ পরিচালনা করেন। বক্তব্য দেন- জেলা নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক তাজ মো. ইয়াছিন, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার হারুন অর রশিদ, সাহিত্য একাডেমির আহ্বায়ক কবি জয়দুল হোসেন, সুর সম্রাট আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন সম্পাদক কবি আবদুল মান্নান সরকার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাট্য সংস্থার সম্পাদক মনজুরুল আলম, কমিউনিস্ট লীগ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মতি লাল বনিক, জেলা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম, জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট কাজী মাসুদ আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ খান, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. অরুনাভ পোদ্দার, নাগরিক ফোরাম সভাপতি কণ্ঠশিল্পী পীযুষ কান্তি আচার্য, নারী মুক্তি সংসদ সভাপতি ফজিলাতুন্নাহার, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পাঠাগারের অ্যাডভোকেট নাসির মিয়া, আবরণীর নির্বাহী পরিচালক হাবিবুর রহমান পারভেজ, মহিলা পরিষদ সাংগঠনিক সম্পাদক আসমা খানম, ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম। সভায় বক্তারা ভিডিও ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের দাবি জানান। এ দাবিতে সংস্কৃতিকর্মীরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। নতুন ৩ মামলা : বুধবার রাতে সুর সম্রাট আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনের সম্পাদক কবি আবদুল মান্নান সরকার, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পাঠাগারের সম্পাদক আবদুন নূর ও তিতাস সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ সম্পাদক আবদুল বাছির দুলাল তিনটি মামলা করেন। এগুলোতে দুই হাজার লোককে আসামি করা হয়েছে। এর আগে বুধবার দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনের মাস্টার এসএম মহিদুর রহমান আখাউড়া রেলওয়ে থানায়, সদর থানা পুলিশের এসআই রুবেল ফরাজী, শহরের হালদারপাড়ায় পর্দা ব্যবসায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় মার্কেটের পর্দা বিতানের মালিক ফেরদৌস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট চমন সিকান্দার জুলকারনাইন, প্রশিকার ম্যানেজার হুমায়ুন কবীর, জেলা সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. রানা নূরুস শামস বাদী হয়ে মামলা করেন। হাসপাতাল ভাংচুরের ঘটনায় আরেকটি মামলা হয়। এগুলোতে আসামি করা হয়েছে ৬ সহস াধিক লোককে।

সদর মডেল থানার ওসি তদন্ত মফিজ উদ্দিন জানান, এরই মধ্যে সদর থানায় ৮টি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। আরও কয়েকটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আমরা আসামিসহ নাশকতা, ভাংচুর, আগুনের ঘটনায় অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চালাব। নতুন তদন্ত কমিটি : ঘটনা সরেজমিনে খতিয়ে দেখে জরুরি ভিত্তিতে প্রতিবেদন দিতে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার শফিকুল ইসলামকে প্রধান ও সহকারী পুলিশ সুপার ডিএসবি মোহাম্মদ মাহবুব আলম খান ও ওসি ডিএসবি মো. আবদুল হান্নানকে সদস্য করে নতুন এক তদন্ত কমিটি করেছে জেলা পুলিশ। বুধবার রাতে তাদের চিঠি দিয়ে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার এমএ মাসুদ এ দায়িত্ব দেন। চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে আগে গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের দু’দিনের কার্যদিবস শেষ করেছে। রোববার তাদের তদন্তের শেষ কার্যদিবস হলেও এর মধ্যে তদন্ত শেষ করতে পারবে না বলে জানিয়েছেন তারা। সূত্র জানিয়েছে, কমিটি আরও ৭ দিন সময় দেয়ার জন্য আবেদন করবে। ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার এমএ মাসুদ বলেন, আমরা এখনও আইনশৃংখলা পরিস্থিতির উন্নয়নে কাজ করছি। তদন্তে ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারিনি। আগে সবকিছু ঠিক হয়ে যাক।