দুই দেশের হয়ে টানা দুই ফাইনাল খেলেছিলেন যিনি

cf6bb63c45faaceb797870bf51951fb0-5afbbff2e5e73

বিশ্বকাপে খেলার সৌভাগ্য সব ফুটবলারের হয় না। তাহলে যাঁরা দুটি দেশের হয়ে বিশ্বকাপে খেলেছেন তাঁদের কি বলবেন, মহা সৌভাগ্যবান? এই দলে আছেন বেশ কজন। ফেরেঙ্ক পুসকাস, হোসে আলতাফিনি, হোসে সান্তামারিয়া, রবার্ট প্রসিনেস্কিরা মোটামুটি পরিচিত নাম। কিন্তু ‘প্রথম’ এই কীর্তি গড়া লুই মন্টিকে কজন চেনেন?

বিশ ও তিরিশের দশকে দাপিয়ে খেলেছেন মন্টি। মাঠজুড়ে সপ্রতিভ উপস্থিতি এবং দুর্দান্ত শারীরিক গঠনের জন্য সুনাম কুড়িয়েছিলেন এই মিডফিল্ডার। বিশ্বকাপের ইতিহাসে তিনি আজও একটি জায়গায় অনন্য—দুটি আলাদা দেশের হয়ে টানা দুটি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছেন মন্টি। ১৯৩০ বিশ্বকাপে খেললেন আর্জেন্টিনার জার্সিতে। চার বছর পর ইতালির হয়ে খেললেন দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। প্রথমবার হলেন রানার্সআপ, পরেরবার চ্যাম্পিয়ন। তবে এই দুই ফাইনালই মন্টি খেলেছিলেন মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে।

লুই মন্টি। যখন জুভেন্টাসে খেলতেন। ছবি: জুভেন্টাসের টুইটার পেজলুই মন্টি। যখন জুভেন্টাসে খেলতেন। ছবি: জুভেন্টাসের টুইটার পেজবুয়েনেস এইরেসে জন্ম নেওয়া মন্টি আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে ডাক পান ২৩ বছর বয়সে। ছয় বছর পর ডাক পান আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ দলেও। গ্রুপপর্বে ফ্রান্সের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার জয়সূচক গোলটা আসে তাঁর কাছ থেকে। সেমিফাইনালে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ৬-১ গোলের জয়েও লক্ষ্যভেদ করেছিলেন মন্টি। এরপর উরুগুয়ের বিপক্ষে সেই ফাইনাল।

মন্টি না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ৩৫ বছর আগেই। কিন্তু তাঁর স্মৃতি বুকের মধ্যে সযত্নে আগলে রেখেছেন তাঁর-ই নাতনি লোরেনা মন্টি। ত্রিশের সেই ফাইনাল নিয়ে দুই বছর আগে লোরেনা একবার মুখ খুলেছিলেন, ‘বিরতির সময়েও আর্জেন্টিনা ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল। লোকে বলে, আর্জেন্টিনা না হারলে ওঁরা আমার দাদাকে মেরে ফেলত।’

অবশ্য শুধু মন্টি নয় আর্জেন্টিনার আরও কজন খেলোয়াড়কে মৃত্যুর হুমকি দিয়েছিল উরুগুয়ের সমর্থকেরা। প্রথমার্ধ শেষে যে আর্জেন্টিনা ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল দ্বিতীয়ার্ধ শেষে সেই দলটাই হারল ৪-২ ব্যবধানে! বিরতির পর তিন গোল হজম করেছিল আর্জেন্টিনা। এই হারে আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা কষ্ট পেলেও মন্টি নিশ্চয়ই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন, যাক জানটা তো বাঁচল!

সেই মন্টিই পরের বিশ্বকাপে খেলেছেন ইতালির হয়ে। ১৯৩০ সালের সেই ফাইনালের পর জন্মভূমির হয়ে মাত্র একটি ম্যাচ খেলেছিলেন মন্টি। পরের বছর তিনি সই করেন জুভেন্টাসে। এর মধ্যে ইতালিয়ান নাগরিকত্বও পেয়ে যান। মুসোলিনির সেই ফ্যাসিস্ট শাসনামলে নিয়ম ছিল, পূর্বপুরুষদের কেউ ইতালিয়ান হলে তিনি ইতালির পাসপোর্ট পাবেন। কথিত আছে, ইতালির জাতীয় ফুটবল দল শক্তিশালী করতেই এই নিয়ম চালু করেছিলেন মুসোলিনি। আর তাই মন্টিকে দলে ভেড়াতে ১৯৩০ বিশ্বকাপের সেই ফাইনালে তাঁকে হুমকি দিয়েছিলেন একজন ইতালিয়ান, উরুগুয়ের কেউ নয়। মন্টি যেন জন্মভূমির সঙ্গে সম্পর্কের পাট চুকিয়ে দেন সে জন্যই এই চক্রান্ত। যদিও এসব কথার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ নেই।

মন্টির পাসপোর্ট। ফিফা ওয়ার্ল্ড ফুটবল জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে এই পাসপোর্ট। ছবি: ফিফা জাদুঘরের টুইটার পেজমন্টির পাসপোর্ট। ফিফা ওয়ার্ল্ড ফুটবল জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে এই পাসপোর্ট। ছবি: ফিফা জাদুঘরের টুইটার পেজ১৯৩৪ বিশ্বকাপে মন্টির দল ইতালি ফাইনালে উঠল। সেবারও পেলেন মৃত্যুর পরোয়ানা। লোরেনাই বলেছেন কাহিনিটা, ‘চেকোশ্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ১৯৩৪ বিশ্বকাপের ফাইনালের আগে ইতালির ড্রেসিং রুমে এক লোক এসে একটা বার্তা দিয়ে যায়। সেটা ছিল বেনিতো মুসোলিনির তরফ থেকে (তখন ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসক)। সেই বার্তায় লেখা ছিল ম্যাচটা জিততে না পারলে চরম ফল ভোগ করতে হবে। দাদা এসব আমাদের বলে গেছেন।’

ইতালির প্রেসিডেন্ট সেই বার্তায় লিখেছিলেন, ‘ভিনকেরি ও মোরিরে’। বাংলায় ‘জেতো নয়তো মরো’। যদিও মুসোলিনির এই বার্তা নিয়ে দ্বিমত আছে। কেউ কেউ বলেন মুসোলিনি ছিলেন চরম দক্ষিণপন্থী, আর তাঁদের স্লোগানই ছিল ‘ভিক্টরি অর বাস্ট’। অনেকের মতে, মুসোলিনি তাঁর সেই বার্তায় এ কথাটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন। সে যাই হোক, ফাইনালে ২-১ গোলের জয়ে জান বাঁচিয়েছিলেন ইতালির খেলোয়াড়েরা।

বিশ্বকাপের ফাইনালে হেরে মন্টি জন্মভূমি ছেড়েছিলেন। পরে ইতালির হয়ে বিশ্বকাপ জিতে তিনি আবার বুয়েনেস এইরেসে ফিরেছিলেন। আর্জেন্টাইন পরিচয়টা কোনো দিন ফিকে হতে দেননি তিনি। ফিফা ওয়ার্ল্ড ফুটবল জাদুঘরে আজও তাঁর আর্জেন্টাইন পাসপোর্ট সংরক্ষিত আছে। কোনো উৎসুক ফুটবলপ্রেমী আজ সেই পাসপোর্ট দেখলে হয়ত হঠাৎ করেই জানতে পারবেন, গতকাল ছিল মন্টির জন্মদিন!