শুরু হচ্ছে ট্রানজিট

মাশুল আরোপ করে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া হচ্ছে। নৌপথেই প্রথম এ ধরনের ট্রানজিট হবে। মাশুল নেওয়া হবে টনপ্রতি ১৯২ টাকা। ইতিমধ্যে কলকাতা থেকে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় পণ্য নিতে দুই দেশের নৌ প্রটোকলের আওতায় ট্রানজিটের অনুমতি দেওয়া শুরু হয়েছে। ট্রানজিটের প্রথম চালান হিসেবে আগরতলায় যাবে এক হাজার টন ঢেউটিন। নৌ প্রটোকলের আওতায় ট্রানজিট হলেও তা বহুমাত্রিক ব্যবস্থায় পণ্য পরিবহন করা হবে। কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত নৌপথে, এরপর আশুগঞ্জ থেকে সড়কপথে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আগরতলায় পণ্য নেওয়া হবে। ১৫ মে এক হাজার টন ঢেউটিনের চালান কলকাতা থেকে আগরতলায় নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এ জন্য প্রতি টনে ১৯২ টাকা করে মাশুল দিতে হবে। যদিও ট্যারিফ কমিশনের নেতৃত্বে গঠিত ট্রানজিট-সংক্রান্ত কোর কমিটির টনপ্রতি ১ হাজার ৫৮ টাকা মাশুল আদায়ের সুপারিশ ছিল। সুপারিশ মেনে নিলে বাংলাদেশ এক হাজার টন পণ্য ট্রানজিটে কেবল মাশুল হিসেবেই পেত ১০ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। আর এখন পাবে মাত্র ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ গত সোমবার টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, কোর কমিটি অনেক চিন্তাভাবনা এবং যৌক্তিকতা বিবেচনা করে মাশুলের পরিমাণ সুপারিশ করেছে। কিন্তু নৌপথে যে মাশুল নেওয়া হচ্ছে, তা অনেক কম। তবে মূল বিষয় হলো, নৌপথে পণ্য পরিবহন করা হলে ভারত যতটা লাভবান হবে, এর একটি বড় অংশ বাংলাদেশের পাওয়া উচিত। তিনি মনে করেন, টনপ্রতি ১৯২ টাকা মাশুল কিসের ভিত্তিতে করা হলো, এর ব্যাখ্যা প্রয়োজন। সড়কের ওপর এমনিতেই চাপ আছে। তাই প্রথমে নৌ ও রেলপথেই ট্রানজিট দেওয়া সমীচীন।

তবে সরকারি সূত্রগুলো বলছে, নৌপথে ট্রানজিট শুরু হলেও আপাতত সড়ক ও রেলপথে ট্রানজিট হচ্ছে না। সড়কপথে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে ট্রানজিট ব্যবস্থা চালুর প্রক্রিয়া এক বছর ধরে আটকে আছে। আর রেলপথে ট্রানজিটের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ বেশ সময়সাপেক্ষ। তিন বছর আগে নৌ প্রটোকলের আওতায় কলকাতা-আশুগঞ্জ-আখাউড়া-আগরতলা পথে কোনো ধরনের মাশুল ছাড়াই একটি পরীক্ষামূলক চালানে লোহার চালান আগরতলায় গেছে। এ ছাড়া এ পথটি ব্যবহার করে ত্রিপুরার গেছে পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রাংশ এবং ১০ হাজার টন চাল। ভারত সরকারের বিশেষ অনুরোধে বাংলাদেশ সরকার মানবিক কারণে এই অনুমতি দিয়েছিল। নৌ প্রটোকলের আওতায় আগে কলকাতা-আশুগঞ্জ-আখাউড়া-আগরতলা রুট ছিল না। এ পথে নিয়মিত ট্রানজিট চালু করার জন্য বিদ্যমান নৌ প্রটোকলের ধারা সংশোধন করা হয়েছে। গত বছরের ১৬ থেকে ১৮ নভেম্বর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের নৌসচিব পর্যায়ের সভায় আশুগঞ্জ হয়ে আগরতলায় পণ্য নেওয়ার জন্য বিদ্যমান প্রটোকল সংশোধনে সমঝোতা স্মারক হয়। একই সভায় মাশুলের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। আশুগঞ্জ নৌবন্দরকে ট্রান্সশিপমেন্ট পয়েন্ট (পণ্য স্থানান্তর করার স্থান) ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর দুই দেশের সরকারের অনাপত্তিপত্রের পরিপ্রেক্ষিতে এখন নিয়মিত হচ্ছে ট্রানজিট ব্যবস্থাটি।

ত্রিপুরা সরকারের এক হাজার টন ঢেউটিনের চালানটি কলকাতা থেকে আগরতলায় পৌঁছে দেওয়ার ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে বাংলাদেশের আনবিস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এর আগে এ পথে পরীক্ষামূলক চালান কিংবা বিশেষ অনুমতি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে দেওয়া হয়েছিল। এখন থেকে যেহেতু নিয়মিত ট্রানজিট হবে, তাই চালানের অনুমতি দিচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ট্রানজিট চালানের অনুমতির জন্য বিআইডব্লিউটিএতে আবেদন জমা পড়েছে।
এমন আরেকটি আবেদন হলো ত্রিপুরার সরকারের গণপূর্ত বিভাগের দুই হাজার টন রডের চালান। গত জানুয়ারি মাসে কলকাতার রাশমী মেটালিকস লিমিটেডের কাছ থেকে দুই হাজার টন রড কিনেছে ত্রিপুরা সরকারের গণপূর্ত বিভাগ। ইতিমধ্যে জরুরি প্রয়োজনের তাগিদে ৫০০ টন কলকাতা থেকে সড়কপথে মেঘালয় ও আসাম হয়ে আগরতলায় পৌঁছে দিয়েছে রাশমী মেটালিকস। এরপর রাশমী মেটালিকস বাকি রড নৌপথে আগরতলায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান নেক্সাস করপোরেশনকে কার্যাদেশ দেয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব অশোক মাধব রায় গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, নৌ ট্রানজিট নেওয়ার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যেকোনো সময়ে এ পথে ট্রানজিট শুরু হতে পারে। উভয় পক্ষের দর-কষাকষির ভিত্তিতেই মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য দেখভালের দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। নৌ ট্রানজিট বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য-সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি বাস্তবায়ন করতে যেসব প্রটোকল করা হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়নের এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। তাই নৌ প্রটোকলের আওতায় ট্রানজিট প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করছে নৌ মন্ত্রণালয়।

আগে বিদ্যমান নৌ প্রটোকলের আওতায় নৌপথে ট্রানজিটের জন্য বার্ষিক থোক অর্থ দিত ভারত সরকার। এর পরিবর্তে এখন শুল্ক বিভাগ, বিআইডব্লিউটিএ ও সড়ক বিভাগকে প্রতি টনে মোট ১৯২ টাকা মাশুল দিতে হবে। এর মধ্যে ১৩০ টাকা পাবে শুল্ক কর্তৃপক্ষ। সড়ক বিভাগকে প্রতি টনে ৫২ টাকা দিতে হবে, আর ১০ টাকা পাবে বিআইডব্লিউটিএ। এর বাইরে ট্রানজিট পণ্য পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান যদি পণ্যের নিরাপত্তা চায়, তবে প্রতি টনে আরও ৫০ টাকা এসকর্ট মাশুল গুনতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ৪৭ কিলোমিটার সড়কপথেই মূলত পুলিশি পাহারার প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া পণ্য ওঠানো-নামানোর ক্ষেত্রে নৌ প্রটোকলের আওতায় অন্য যেসব চার্জ আছে, যেমন বার্থিং, লেবার হ্যান্ডলিং, ল্যান্ডিং, পাইলটেজ এবং কনজারভেন্সি চার্জ দিতে হবে। বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, এসব চার্জ আদায় করা হলে টনপ্রতি বাড়তি এক শ থেকে দেড় শ টাকা পাওয়া যাবে।

মাশুলের সুপারিশ মানা হয়নি: ভারত, নেপাল ও ভুটানকে সড়ক, রেল ও নৌপথে ট্রানজিট দিতে ২০১১ সালে ট্যারিফ কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কোর কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটির নৌপথে টনপ্রতি ১ হাজার ৫৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আর এখন যে মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে, তা পাঁচ গুণের কম। ওই কমিটির প্রধান মজিবুর রহমান গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ওই প্রতিবেদনে ট্রানজিটের সম্ভাব্যতা, পণ্য পরিবহনের প্রবাহ, বিনিয়োগসহ বিষয়ে হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছিল। ওই মাশুলের পরিমাণ পুরোপুরি যৌক্তিক। তবে নৌপথের মাশুল নির্ধারণ কোন কোন বিবেচনায় করা হয়েছে, তা বোধগম্য নয়