‘ভেঙে পড়া’ জেএমবি হামলায় এগিয়ে!
শীর্ষনেতাদের ফাঁসি এবং টানা অভিযানে যে জেএমবির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার দাবি করে আসছিল পুলিশ, সেই সংগঠনটিকেই গত তিন বছরে অধিকাংশ জঙ্গি হামলার জন্য দায়ী করছে তারা।
সাম্প্রতিক খুনগুলোতে পুলিশের তদন্ত নিয়ে অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক এক সংবাদ সম্মেলনে হামলার ঘটনাগুলোর যে পরিসংখ্যান দেন, তাতে জেএমবির সম্পৃক্ততার বিষয়টিই প্রধান হয়ে আসে।
পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার খুনের পর থেকে তিন দিন আগে টাঙ্গাইলে হিন্দু দর্জি নিখিল জোয়ারদার হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ৩৭টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।
এসব হামলার ২৫টিতে জেএমবি জড়িত বলে পরিসংখ্যানে তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রংপুরে জাপানি কুনিও হোসি, রাবি শিক্ষক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী ও দর্জি নিখিল ও পুলিশ হত্যাকাণ্ডগুলো রয়েছে।
আটটি হত্যাকাণ্ডে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জড়িত বলে দাবি পুলিশের। এর মধ্যে রয়েছে রাজীব থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয়সহ অধিকাংশ ব্লগার হত্যার ঘটনাগুলো।
বাকি চারটি হত্যাকাণ্ডে নাম উল্লেখ না করে ‘সন্ত্রাসী/জঙ্গি গোষ্ঠী’কে দায়ী করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকায় ইতালির নাগরিক চেজারে তাভেল্লা, ঝিনাইদহে আব্দুর রাজ্জাক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো।
বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার ঘটনাটি প্রকাশ্য হয়েছিল প্রায় এক যুগ আগে জেএমবি-জেএমজেবির মাধ্যমে। ২০০৫ সালে সারাদেশে একযোগে বোমাহামলা চালিয়ে আলোড়ন তুলেছিল জেএমবি।
২০০৫ সালে জেএমবি-জেএমজেবির সঙ্গে হরকাতুল জিহাদ ও শাহদাৎ-ই আল হিকমা নামে আরও দুই সংগঠনের তৎপরতা ধরা পড়ার পর এই সবগুলো সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়।
এর কয়েক বছরের মধ্যে শায়খ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ জেএমবির শীর্ষনেতাদের ফাঁসিতেও ঝোলানো হয়।
তারপর থেকে অভিযানে অসংখ্য জঙ্গি সদস্যকে গ্রেপ্তার এবং অস্ত্র-বিস্ফোরক উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেন, জেএমবির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে। একই কথা কয়েক বছর আগে আসে বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের কণ্ঠেও।
এর মধ্যেই ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে দলের নেতা সালাউদ্দিন সালেহীন সানি এবং রাকিবুল হাসান হাফেজ মাহমুদ ও জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজানকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদের সক্ষমতা দেখিয়ে দেয়। এদের মধ্যে রাকিবুল পরে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান।
তবে মঙ্গলবার পুলিশ প্রধানের দেওয়া জঙ্গি হামলার পরিসংখ্যানে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে কনস্টেবল আতিকুল ইসলামকে মেরে তিন জঙ্গি নেতাকে ছিনতাইয়ের ঘটনাটি নেই।
মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানী নেতৃত্বাধীন আনসারুল্লাহ বাংলাটিম সংগঠনটি আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে রাজীব হত্যাকাণ্ডের পর। ২০১৫ সালে নিষিদ্ধ হওয়া এই সংগঠনের প্রধান রাহমানী এখন কারাগারে।
এছাড়া হামজা ব্রিগেডসহ আরও কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের নাম নানা সময়ে পুলিশের বক্তব্যে এলেও তাদের তৎপরতার খবর খুব একটা দেখা যায়নি পরে।
কয়েক বছর আগে ভারতের কাশ্মিরভিত্তিক লস্কর-ই তৈয়বার একাধিক সদস্যকে বাংলাদেশে গ্রেপ্তারের দাবি র্যাব-পুলিশ করে। এরপর আইএস সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের দাবিও করা হয়।
কিন্তু যখন থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আইএস কিংবা আল কায়দার বার্তা আসার খবর আসতে থাকে; তখন থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলতে থাকেন, বাংলাদেশের জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর কোনো যোগাযোগ নেই।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ মহাপরিদর্শক শহীদুলও বলেন, “যারা গ্রেপ্তার হয়েছে, তারা কেউ বলেনি যে তাদের সঙ্গে আইএসের কোনো সম্পর্ক আছে। আর গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিরা হাই-ফাই ক্রিমিনাল না যে তাদের ইন্টারন্যাশনাল কানেকশন থাকবে।”
প্রায় সব ‘রহস্য উদ্ঘাটিত’
যে ৩৭টি হামলার পরিসংখ্যান দিয়েছেন আইজিপি, তার মধ্যে ৩৪টিতেই মূল ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে মাত্র ছয়টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
‘মূল ঘটনা উদ্ঘাটিত’ হওয়ার মধ্যে অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাস, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়, ফয়সাল আরেফিন দীপন, দুই বিদেশি তাভেল্লা ও হোসি, এমনকি রাবি শিক্ষক রেজাউল হত্যাকাণ্ডও রয়েছে।
দাবি করা হলেও কীভাবে মূল ঘটনা উদঘাটন হয়েছে, তার সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি পুলিশের কাছ থেকে।
অভিযোগগপত্র দেওয়ার পর রাজীব হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হলেও অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের মধ্যে শুধু ওয়াশিকুর রহমান বাবুর হত্যাকারীদের অভিযোগপত্র হয়েছে।
রাজীব হত্যাকাণ্ডের কথিত হোতা রেদোয়ানুল আজাদ রানাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এই রানা অভিজিৎসহ আরও হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে পুলিশেরই দাবি।
ওয়াশিকুর হত্যার পর দুজনকে ঘটনাস্থল থেকে ধরিয়ে দিয়েছিল স্থানীয়রাই। আইজিপির পরিসংখ্যানে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানানো হয়েছে, যদিও অভিযোগপত্রে আসামির সংখ্যা পাঁচ।
প্রতিবেদনের দাবি অনুযায়ী, গত মাসের তিনটি হত্যাকাণ্ড নাজিমুদ্দিন সামাদ, জুলহাজ-তনয় ও দর্জি নিখিল খুন বাদে শুধু গত বছরের নভেম্বরে বগুড়ার শিয়া মসজিদে হামলার ঘটনার রহস্যভেদ এখনও করতে পারেনি পুলিশ।
মোট ৩৭টি ঘটনার মামলায় ১৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে, এর মধ্যে ৪৯ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় ৮জন, সৈয়দপুরে মাজারে খাদেম হত্যার ঘটনায় ১০জন, দিনাজপুরে ইতালি নাগরিক পিয়েরো পারোলারিকে হত্যার চেষ্টার ঘটনায় ৬জন, ফরিদপুরে অলোক সেনকে হত্যার চেষ্টার ঘটনায় ৫জন, দিনাজপুরে কান্তজিউর মন্দিরে রাস মেলায় হামলার ঘটনায় ৩জন, ঝিনাইদহে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক ছমির মণ্ডল হত্যা মামলায় ৪জন, গাইবান্ধায় হিন্দু ব্যবসায়ি তরুণ দত্ত হত্যা মামলায় ১জন, ঝিনাইদহে আব্দুর রাজ্জাক হত্যা মামলায় ২জন, কুড়িগ্রামে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান হোসেন আলী সরকার হত্যা মামলায় ৩জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রেজাউল করিম হত্যা মামলায় ৩জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এসব পরিসংখ্যান তুলে ধরে আইজিপি শহীদুল হক বলেন, “যারা পুলিশের ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলেন, যারা বলেন, পুলিশ পারতেছে না, তাদের জন্য এই প্রতিবেদন যে ৩৭টি ঘটনার মধ্যে ৩৪টি ঘটনার কারণ সুন্দরভাবে উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশ পুলিশের ব্যর্থতা এখানে নেই।”